আরও ২৫ লাশ উদ্ধার, মৃতের সংখ্যা ৫০
এখনো নিখোঁজ অর্ধশতাধিক * জেলা প্রশাসনের পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি
পঞ্চগড়ের করতোয়া নদীতীরে হাজারো স্বজনের অপেক্ষা। কারও চোখে পানি। কেউ কাঁদতে কাঁদতে চুপসে গেছেন। কেউ বা শোকে পাথর। উদ্ধারকর্মীরা একের পর এক লাশ তুলে আনছেন অমনি তারা লাশ শনাক্ত করে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। রোববারের নৌকাডুবির ঘটনায় আরও ২৫ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫০। দুর্ঘটনাস্থল থেকে ২০-৩০ কিলোমিটার দূরেও লাশ পাওয়া যাচ্ছে। ডুবে যাওয়া শতাধিক যাত্রীবাহী ওই নৌকার আরও অনেক যাত্রী এখনো নিখোঁজ। যদিও নিখোঁজের সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে নিখোঁজ অর্ধশতাধিক লোকের তালিকা দিয়েছে স্বজনরা। একই পরিবারের ৪ থেকে ৬ জন বা তারও অধিক সদস্য নৌকাডুবিতে প্রাণ হারিয়েছে। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওসহ আশপাশের এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
এদিকে নৌকাডুবির ঘটনায় রোববার রাতে পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপংকর রায়কে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসন। কমিটিকে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সোমবার সকাল সাড়ে ৮টায় করতোয়া নদীর তীরে নিখোঁজ স্বজনদের খুঁজতে আসেন মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের গেদীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মহাদেব রায়। তিনি জানান, তার দুই কাকি ও মামাসহ আট স্বজন নিখোঁজ। তাদের কাউকে খুঁজে না পেয়ে করতোয়ার তীরে বিলাপ করছিলেন তিনি।
প্রিয়জনকে খুঁজে পাওয়ার আশায় জগেশ রায়, প্রদীপ চন্দ্রসহ কয়েকজন নৌকা নিয়ে নদীতে চষে বেড়াচ্ছেন। নিখোঁজদের ছবি নদীতীরের বাসিন্দাদের দেখাচ্ছেন আর বিলাপ করছেন। এমন আরও অনেক স্বজন বলেন, তারা নিখোঁজ স্বজনদের লাশ যেন বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন, সেই অপেক্ষায় আছেন। ৬ বছরের মিম ও তার বোন নবম শ্রেণির ছাত্রি পূজার এবার চাওয়া ছিল শারদীয় উৎসবে তিন সেট পোশাক আর বোদেশ্বরী মন্দির দর্শন। বাবা দীপক চন্দ্র রায় দুই মেয়ের পছন্দমতো দুই সেট করে পোশাক কিনেও দিয়েছেন। ইচ্ছা ছিল ছোট মেয়ে মিমের আবদার বোদেশ্বরী মন্দির দেখে আসার পর কিনে দেবেন আরেক সেট। কিন্তু পঞ্চগড়ের বোদার আউলিয়ার ঘাট এলাকায় করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় চিরতরে হারিয়ে গেছে মিম। আর বোন পূজার লাশের সন্ধানে স্বজনরা অপেক্ষা করছেন নদীতীরে। অলৌকিক কিছু না ঘটলে পূজা আর মিমকে কোনোদিনই ফিরে পাবেন না দীপক চন্দ্র রায় ও ছন্দা রানী দম্পতি।
বৃদ্ধ সুমল চন্দ্র। সারারাত চরম উৎকণ্ঠায় কেটেছে করতোয়া নদীর তীরে। বসে আছেন নৌকাডুবিতে নিখোঁজ নাতির খোঁজে। তিনি এসেছেন বোদা উপজেলার পাঁচপীর থেকে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, নাতির লাশটা পেলে অন্তত নিজেরা সৎকারের কাজটা করতে পারতাম। উদ্ধার সংশ্লিষ্টরা জানান, আরও ২৫ লাশের মধ্যে ঘটনাস্থলের আশপাশ থেকে সাতজন এবং দিনাজপুরের বীরগঞ্জ, খানসামা ও সদর উপজেলার নদী থেকে উদ্ধার হয়েছে আটজন। বাকিদের অন্যান্য স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১২ শিশু, ২৪ নারী ও ১৪ জন পুরুষ। ২৯ জন পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার, দেবীগঞ্জের ১৮ জন, আটোয়ারীর একজন, পঞ্চগড় সদরের একজন ও ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার একজন।
নিহতরা হলেন-হাশেম আলী (৭০) শ্যামলী রানী (১৪), লক্ষ্মী রানী (২৫), অমল চন্দ্র (৩৫) শোভা রানী (২৭), দিপঙ্কর (৩), পিয়ন্ত (২.৫), রুপালি ওরফে খুকি রানী (৩৫), প্রমীলা রানি (৫৫), ধনবালা (৬০), সুনিতা রানী, (৬০), ফাল্গুনী (৪৫), প্রমীলা দেবী ও জ্যোতিশ চন্দ্র (৫৫), তারা রানী (২৫), সানেকা রানী (৬০), সফলতা রানী (৪০), বিলাশ চন্দ্র (৪৫), শ্যামলী রানী ওরফে শিমুলি (৩৫), উশোশি (৮), তনুশ্রী (৫), শ্রেয়সী ও প্রিয়ন্তী (৮), সনেকা রানী (৬০), ব্রজেন্দ্র নাথ (৫৫), ঝর্ণা রানী (৪৫), দীপ বাবু (১০), সুচিত্রা (২২), কবিতা রানী (৫০), বেজ্যে বালা (৫০), দিপশিখা রানী (১০), সুব্রত (২), জগদীশ (৩৫), যতি মিরর্ময় (১৫), গেন্দা রানী, কনিকা রানী, সুমিত্রা রানী, আদুরী রানী (৫০), পুষ্পা রানী ও প্রতিমা রানী (৫০), সূর্যনাথ বর্মণ (১২), হরিকেশর বর্মণ (৪৫), নিখিল চন্দ্র (৬০), সুশীল চন্দ্র (৬৫), যুথি রানী (০১), রাজমোহন অধিকারী (৬৫), রূপালী রানী (৩৮), প্রদীপ রায় (৩০), পারুল রানী (৩২) ও প্রতীমা রানী (৩৯)। তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপঙ্কর কুমার রায় জানান, বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের আউলিয়ার ঘাট এলাকায় নৌকাডুবিতে নিখোঁজের সঠিক সংখ্যা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে স্বজনরা নিখোঁজ ৬৬ জনের তালিকা দিয়েছেন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান জানান, তিনটি ইউনিটের ডুবুরি দল তিন ভাগে ভাগ হয়ে ঘটনাস্থল থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত সোমবার সকাল সাড়ে ৫টা থেকে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে। রোববার ২৫ জনের লাশ উদ্ধার করে রাত ১১টায় উদ্ধার কাজ মুলতবি করা হয়েছিল। মঙ্গলবার (আজ) সন্ধ্যা পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান চলবে। তিনি বলেন, অর্ধশত নিখোঁজ থাকতে পারে। এদিকে রোববার রাতে রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন এবং সোমবার দুপুরে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান ও পানিসম্পদ মন্ত্রনালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতি রমেশ চন্দ্র সেন এমপি দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ সময় রেলপথমন্ত্রী আউলিয়ার ঘাটে পূর্ব প্রতিশ্রুত ওয়াই আকৃতির সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া দ্রুত কার্যকরের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বেদনাদায়ক এ দুর্ঘটনা সম্পর্কে অবগত আছেন এবং তিনি নিহত ও আহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে ২৫ হাজার টাকার চেক দেন। এছাড়া নিহতদের পরিবারের স্বজনদের দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ১ লাখ টাকা করে, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার করে টাকা, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার করে টাকা ও আহতদের ৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
রোববার দুপুর আড়াইটায় মহালয়া পূজা উপলক্ষ্যে বদেশ্বরী মন্দিরে যাওয়ার পথে করতোয়া নদীতে শতাধিক যাত্রী নিয়ে নৌকা ডুবে যায়।
এক পরিবারের চারজন মৃত : পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙা ইউনিয়নের ছত্রশিকারপুর এলাকার লিপি রানীসহ মারা গেছেন চারজন। অন্যরা হলো লিপি রানীর ৪ বছর বয়সি ছেলে বিষ্ণু বর্মণ, লিপির কাকা কার্তিক বর্মণের স্ত্রী লক্ষ্মী রানী ও লিপির স্বামী রবিনের ভাতিজা তিন বছর বয়সি দীপঙ্কর বর্মণ। রবিন বর্মণ বলেন, স্ত্রী-সন্তানকে পাঠিয়েছিলাম মহালয়া অনুষ্ঠানে।
সাঁতরে তীরে ওঠেন সুবাস রায় : নৌকা ডুবে যাওয়ার পর তীরে সাঁতরে ওঠেন মাড়েয়া বামনপাড়া এলাকার সুবাস চন্দ্র রায়। তিনি বলেন, আমরা নৌকায় ওঠার কিছুক্ষণ পরই নৌকায় পানি ঢুকতে শুরু করে।
দুধের শিশুকে বুকে নিয়ে বেঁচে ফিরলেন মা-নিখোঁজ মেয়ে : বিপাশা চন্দ্র (৩১)। নৌকায় ওঠার সময়ের কথা বলছিলেন এভাবে, নৌকাটিতে ওঠার সময় নৌকা অতিরিক্ত ভারে দুলতে থাকে। তবুও চাপাচাপি করে স্বামী, দুই সন্তান ও শাশুড়িসহ উঠেছিলাম নৌকায়। মাঝিরা কইছিল কিছুই হবে না। যাওয়া যাবে। কিন্তু দুলতে দুলতে মাঝখানে গিয়ে উলটে গেল নৌকা। আমার বুকে দুধের সন্তান। বাম হাত দিয়ে বাচ্চাটা ধরে রাখছি আর ডান হাত দিয়ে নৌকা।