ভয়াবহ যানজটে গতকাল নাকাল হয়েছে রাজধানীবাসী। কয়েক দিন ধরে দেশজুড়ে চলছে তীব্র গরম। এরই মধ্যে রোববার ভোর থেকে শুরু হয় স্বস্তির বৃষ্টি। কিন্তু এই বৃষ্টি রাজধানী ও আশপাশের জেলায় চলাচলরত যাত্রীদের কাছে কাল হয়ে দাঁড়ায়। দেখা দেয় দিনভর ভয়াবহ যানজট। রোববার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত এমন চিত্রের দেখা মিলেছে রাজধানীর উত্তরার আবদুল্লাহপুর, বিমানবন্দর, বনানী, মহাখালী এবং নারায়ণগঞ্জের প্রবেশমুখে যাত্রাবাড়ী ও গাজীপুর মহানগর এলাকায়। যানজটে পড়ে অনেকে পায়ে হেঁটে গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে বাধ্য হন।
নগরবাসীর অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে উত্তরা বিমানবন্দরে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজের কারণে রাস্তার খানাখন্দ তৈরি হয়ে এই যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির কারণে বেশির ভাগ রাস্তা পানিতে তলিয়ে যায়। এতে সাধারণ নগরবাসী থেকে শুরু করে অফিসগামীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। যানজট অবস্থায় দুপুরে মোটর বসিয়ে সড়ক থেকে পানি সরাতে দেখা গেছে উত্তরা ট্রাফিক পুলিশকে। রোববার সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত বিমানবন্দর সড়কে যান চলাচল প্রায় থমকে ছিল। ঢাকার ভেতরে প্রবেশ এবং বের হওয়ার দুই পথেই ছিল তীব্র যানজট। সেই সঙ্গে সড়কের মোড়গুলোতে ছিল কাজে বের হওয়া মানুষের ভিড়। এ কারণে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটাও দায় হয়ে পড়ে। যানজটের কারণে বাসে না উঠে হেঁটে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হন অনেকে। যারা বাসে করে যাচ্ছিলেন যানজট তীব্র হওয়ায় তারাও বাস থেকে নেমে হাঁটা শুরু করেন। এই পথে যাতায়াতকারীরা বলছেন, এমনিতেই এই সড়কে তাদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। তার মধ্যে রোববার ভোরের বৃষ্টি ভোগান্তি বাড়িয়েছে কয়েক গুণ।
উত্তরা বিমানবন্দর রোডের আবদুল্লাহপুর থেকে ঢাকামুখী সড়কে উত্তরা, এয়ারপোর্ট, খিলক্ষেত, বিশ্বরোড, বনানী ও কুড়িল প্রগতি সরণিজুড়ে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও বিমানবন্দর রোডের যানজট বনানী, বিশ্বরোড, খিলক্ষেত, কাওলা, মহাখালী, ফার্মগেট, শাহবাগ ও গুলিস্তানসহ রাজধানীজুড়ে যানবাহনের দীর্ঘ সারির সৃষ্টি হয়। ভোগান্তিতে পড়তে হয় হাজার হাজার মানুষকে।
গাজীপুর থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যানজট : ঢাকা-ময়নসিংহ মহাসড়কে উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের খানাখন্দে রোববার ভোরে বৃষ্টির পানি জমে গাজীপুর মহানগরীর কুনিয়া তারগাছ থেকে ঢাকার এয়ারপোর্ট পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলো এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়। এ যানজটে দুর্ভোগে পড়ে ওই মহাসড়কে চলাচলকারী যাত্রীরা। যানজটে অতিষ্ঠ হয়ে গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে চলাচল করেছে অনেক যাত্রী। এতে গাজীপুর অংশে আবদুল্লাহপুর, টঙ্গী বাজার, স্টেশন রোড, মিলগেট, কলেজ গেট ও কুনিয়া তারগাছা পর্যন্ত যানজট সৃষ্টি হয়। তবে বোর্ডবাজার থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত যানচলাচলে ছিল ধীরগতি।
এ বিষয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক) মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ‘মূলত রাজধানীর বিমানবন্দরে সড়কের ওপর পানি জমে থাকায় ঢাকাগামী লেনে যানজট সৃষ্টি হয়। মহাসড়কের টঙ্গী অংশে যথেষ্ট খানাখন্দ সৃষ্টি হয়েছে। বিমানবন্দর এলাকায় মহাসড়কে পানি জমে না থাকলে গাজীপুর থেকে গাড়িগুলোর রাজধানীতে প্রবেশ সম্ভব ছিল। ট্রাফিক পুলিশ যানজট নিরসনে কাজ করেছে। বৃষ্টিতে তৈরি হওয়া মহাসড়কের খানাখন্দ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে ভরাট করা হয়।’
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ : চান্দনা চৌরাস্তা থেকে উত্তরার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম। তিনি জানান, বাসে উঠে কিছু দূর গিয়েই যানজটের মুখে পড়তে হয় তাকে। দীর্ঘ সময় গাড়িতে বসে থাকলেও যানজট না কমায় কোথাও হেঁটে ও রিকশায় অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছেন।
অন্য এক যাত্রী মেহেদী হাসান জানান, বাসের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও বাস না পেয়ে হেঁটেই গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিয়ে পথে সিএনজি ভাড়া করেন। কিন্তু তাতে করেও যানজটের কারণে বেশি দূর এগুতে পারেননি।
অন্যদিকে রোববার সকাল ১০টায় মগবাজার থেকে স্কাইলাইন পরিবহনে ওঠেন কামাল হোসেন। অফিস উত্তরা ৬ নম্বর রোড এলাকায়।
কামাল হোসেন বলেন, ‘সাধারণত এইটুকু পথ যেতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। কিন্তু রোববার মগবাজার থেকে বনানী আসতেই দুই ঘণ্টা লেগেছে।’
আরেক ভুক্তভোগী মোস্তাক আহমেদ জানান, গ্রামের বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে মোহাম্মদপুর থেকে বিমানবন্দর যাবেন। দুপুর ২টায় তার ময়মনসিংহগামী ট্রেন ছাড়ার কথা। কিন্তু বনানীতেই বেজেছে দুপুর ১টা। গাড়িও চলে না। তাই হেঁটে বিমানবন্দর রওনা হন তিনি।
বিমানবন্দর সড়ক হয়ে আসমানী পরিবহনে আসা এনামুল হক নামে এক যাত্রী বলেন, এয়ারপোর্টে সড়ক পুরোটাই অচল হয়ে আছে। কোনো গাড়ি নড়ছে না। হাজার হাজার অফিসগামী মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছে। দুই-তিন ঘণ্টা লাগছে এ সড়ক পাড়ি দিতে। যারা অফিসের জন্য সকালে বের হয়েছেন তারা কেউই যথাসময়ে অফিস পৌঁছাতে পারেননি।
যানজট ভোগান্তি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় : ঢাকার যানজট পরিস্থিতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাবলিক গ্রুপ ট্রাফিক অ্যালার্টে বিভিন্ন পোস্ট করছেন অনেকেই। এদের মধ্যে সাইদুর রহমান নামে একজন লিখেছেন, ‘অভিভাবকহীন বিমানবন্দর সড়কে যানজট নিত্যদিনের সঙ্গী। একদিকে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ অন্যদিকে বৃষ্টি- সব মিলিয়ে সকাল থেকে স্থবির বিমানবন্দর সড়ক। মানুষের ভোগান্তির কোনো শেষ নেই।’
নূর মোহাম্মাদ নামে একজন বাসচালক ঘুমিয়ে থাকার ছবি দিয়ে স্ট্যাটাস দেন, ‘ঢাকা থেকে গাজীপুর যেতে ঘণ্টাখানেক লাগার কথা। সেখানে লাগছে ছয়-সাত ঘণ্টা। দেখা গেছে এক স্থানেই তিন ঘণ্টা বসে থাকতে হচ্ছে। যাত্রীরা অনেকে নেমে হাঁটা শুরু করলেও বাস ছেড়ে যেতে পারেননি চালক। তাই তিনি নিজের আসনেই ঘুমিয়ে নিচ্ছেন। বৃষ্টি হলেই এই চিত্র। তাহলে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না কেন?’
অকশন ফর অকশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা আরিফ আর হোসেন নামে আরেকজন স্ট্যাটাস দেন, ‘নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে রাস্তায় বের হতে হবে…।’
সাত ঘণ্টা পর যানজট পরিস্থিতি স্বাভাবিক : টানা প্রায় সাত ঘণ্টা যানজটের পর বেলা আড়াইটার দিকে বিমানবন্দর সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করে। বিকাল ৪টায় উত্তরা ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) বদরুল হাসান ওই সড়কে যান চলাচল কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে বলে সময়ের আলোকে জানান।
তিনি বলেন, রোববার ভোরের বৃষ্টিতে উত্তরার সড়কের বেশ কিছু এলাকা ডুবে যায়। উন্নয়নমূলক কাজের কারণে সড়কের অনেক জায়গায় খানাখন্দ, গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির কারণে সেসব গর্তে পানি জমে গাড়ি চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এই কারণে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সড়কের অবস্থা স্বাভাবিক করতে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় মোটর বসিয়ে রাস্তায় জমে থাকা পানি সেচ দিয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ জন্য বাড়তি চাপ নিতে হয়েছে ট্রাফিক পুলিশকে। এরপর যানজটে আটকে থাকা গাড়িগুলো চলতে শুরু করে। বেলা আড়াইটার দিকে তা স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
বিআরটি প্রকল্পকে দুষছে নগরবাসী : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ট্রাফিক পুলিশ বলেন, এ এলাকায় বিআরটি লাইন-৩-এর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, টঙ্গী চৌরাস্তা এবং শিববাড়ি-গাজীপুরসহ ২০.২ কিলোমিটার এলাকার কাজ চলছে। নির্মাণকাজের কারণে সড়কে অসংখ্য খানাখন্দ ও গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। কর্তৃপক্ষ এগুলো সঙ্গে সঙ্গে সংস্কার করে না। যে কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিআরটি কর্তৃপক্ষের অবহেলাতেই ভোগান্তিতে পড়েছে নগরবাসী।
এ বিষয়ে বিআরটি উত্তরার একাংশের প্রকল্প পরিচালক এ এস এম ইলিয়াস শাহ সময়ের আলোকে বলেন, ‘উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের কাজের জন্য দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টির কারণে দুঃখ প্রকাশ করছি। আমরা এর দায় এড়াতে পারি না। যত দ্রুত সম্ভব বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি নির্মাণকাজ শেষ করার চেষ্টা চলছে।’