কুমিল্লা ১৭টি উপজেলার ১৮টি থানার অধিকাংশ থানা ভবনের চার পাশেই জরাজীর্ণ গাড়ির স্তূপ। বিভিন্ন মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা এসব মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেল এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। এ যেমন কুমিল্লা নগরীর কোতয়ালী মডেল থানা জব্দ হওয়া গাড়ির ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এসব গাড়ির কারণে ব্যবহৃত গাড়ি তো দূরের কথা হাঁটা চলায়ও বেগ পেতে হচ্ছে পুলিশ সদস্যদের ।
বিশেষ করে এ জেলা সীমান্তবর্তী ১০০ কি.মি. এলাকা হওয়ায় অসংখ্য অবৈধ পরিবহন আসে চোরাই পথে। এছাড়া মামলা, হামলা, দুর্ঘটনা, মাদক পরিবহন, বাইক, ট্রাক, প্রাইভেট কার, সিএনজি ও মাইক্রোবাসসহ বিভিন্ন ধরনের গাড়ি প্রতিদিন আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। থানাগুলোতে বিভিন্ন মামলার এসব গাড়ি পড়ে আছে যুগের পর যুগ।
যদিও প্রতি বছর নিলামের মাধ্যমে মালিক বিহীন কিছু গাড়ি আদালতের মাধ্যেমে বিক্রি করা হয়। তবে কিছু গাড়ি আইনি প্রক্রিয়া শেষ না হওয়ায় থানা হেফাজতে পড়ে থাকে অযত্ন-অবেহেলায়। দেখে যেন মনে হয়, থানাগুলো যেন অলিখিত ডাম্পিং স্টেশন।
কয়েকজন গাড়ির মালিক বলেছেন, অনেক ক্ষেত্রে হয়রানির জন্য পুলিশ গাড়ি জব্দ করে। ম্যানেজ করতে না পারলে সাধারণ মামলার ক্ষেত্রেও অনেক সময় রেকার লাগিয়ে পুলিশ গাড়ি নিয়ে যায়। টার্গেট পূরণ করতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্বিচারে ডাম্পিং করা হয়। নিয়মনীতির মধ্যে থেকে পুলিশ কাজ করলে ডাম্পিংয়ের হাত থেকে গাড়িগুলো রক্ষা পেত।
তবে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে চোরাই, দুর্ঘটনাকবলিত, কাগজপত্রহীন কিংবা মাদকবাহী গাড়িসহ বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত যানবাহন আটক করে থাকে। এর মধ্যে কিছু গাড়ি আদালতের নির্দেশে মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মামলা নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। মামলা নিষ্পত্তি হতে সময় লাগে ১২ থেকে ১৫ বছর। এ সময়ের মধ্যে গাড়ির বেশির ভাগ যন্ত্রাংশই নষ্ট হয়ে যায়। গাড়ি কিংবা এর কোনো অংশ যাতে খোয়া না যায় তা নিশ্চিত করতে বাড়তি নজরদারির রয়েছে আমাদের ।
জব্দ করা গাড়ির কোনো অংশ খোয়া যায় কিংবা চুরি হয়, তাহলে তার দায়ভার পুলিশের কাঁধেই পড়বে। ফলে জব্দ করা গাড়িগুলো থানার বোঁঝা হয়ে দাঁড়ায়। গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় গাড়ি ভালো থাকবে এবং মামলা শেষ হওয়ার পর মালিক সচল গাড়ি পাবে।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জব্দ করা গাড়ি মামলার আলামত। মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা গাড়ি ব্যবহার করলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া সরকারি কাজে মামলার জব্দ করা গাড়ি ব্যবহার করা হলে মানুষ চরম হয়রানির শিকার হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।
জেলার কোতয়ালী মডেল থানা, চৌদ্দগ্রাম থানা, সদর দক্ষিণসহ বেশ কয়েকটি থানা সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগ গাড়ির ইঞ্জিন শুধু নষ্টই হচ্ছে না, আস্ত গাড়ি ক্রমশ মিশে গেছে মাটির সঙ্গে। আবার কিছু গাড়ির ইঞ্জিন নেই শুধু আছে বডি, জব্দ ওইসব গাড়ির কিছু অংশ মামলার দীর্ঘসূত্রিতায় মালিক ফিরে পেলেও ভাঙারি হিসেবে বিক্রি করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। আইনি জটিলতা আর কর্তৃপক্ষের অবহেলায় ধ্বংস হচ্ছে দেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদ। যেহেতু বিষয়টি আদালতের জব্দ আলামত সেহেতু এখানে পুলিশের তেমন কিছু করার থাকে না ।
জেলার বেশিভাগ থানা মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া থানাগুলোর শেড বা ছাউনিহীন খোলা আকাশের নিচে রোদ বৃষ্টি ঝড়ে অযত্নে পড়ে থাকে। এতে জব্দকৃত গাড়ি গুলো যানবাহন নষ্ট হতে হতে ব্যবহার উপযোগিতা হােিরয়ে ফেলেছে।
অভিযোগ রয়েছে এসব গাড়ির বেশিরভাগ পার্স কিছু পুলিশ সদস্য বিক্রি করেন স্থানীয় অটোমোবাইল দোকানগুলোর কাছে। যদিও পুলিশ বলছে আদালতের আলামত বিক্রি করার কোনো সুযোগ নেই।
এদিকে এইসব জব্দকৃত গাড়ি রাখার জন্য জেলাসহ থানা ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের তিনটি হাওইয়ে ডাম্পিং স্টশন থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অর্পযাপ্ত বলছেন জেলা পুলিশ র্কমর্কতারা ।
নাম না প্রকাশের শর্তে জেলা পুিলশের এক র্কমর্কতা জানান, জব্দ গাড়ির ব্যাপারে আদালতের নির্দেশনা আছে। সেই নির্দেশনা মেনে আদালতের অনুমতি নিয়ে পুলিশ কিছু গাড়ি ব্যবহারও করছে। তবে প্রক্রিয়াটা সময় সাপেক্ষ। আর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জব্দ হওয়া গাড়ি পুলিশের ব্যবহারের অনুমতি পেলেও খুব বেশি লাভ হয় না। কারণ কয়েক মাস অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকলে তা নষ্ট হয়ে যায়। সহজ উপায়ে গাড়িগুলো ব্যবহার করলে গাড়ির ক্ষতির পরিমাণ কমবে। পুলিশের ওপর চাপও কমবে।
কুমিল্লা কোয়াতলী থানার ওসি সহিদুর রহমান বলেন, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী জব্দ হওয়ার গাড়ির মালিককে খোঁজ করা হয়। তারপর মালিক না পেলে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গাড়ি পুলিশকে দেওয়া হয়। থানা পুলিশ গাড়িটি পুলিশের পরিবহন পুলে দিয়ে দেয়। সেখান থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করা হয়। তবে তার থানায় আপাতত ব্যবহার উপযোগী কোনো জব্দ করা গাড়ি নেই বলেও জানান।
বিশিষ্ট নগরবিদগণ মনে করেন, মালখানায় স্থান সংকুলান না হওয়ায় এভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে আলামত। চুরি হচ্ছে আলামত (জব্দ করা গাড়ির যন্ত্রাংশ)। দীর্ঘ সময় ধরে উন্মুক্ত স্থানে পড়ে থাকায় অনেক আলামত (গাড়ি) নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এসবই বিচারাধীন বিভিন্ন মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত। মামলার দীর্ঘসূত্রতায় বছরের পর বছর পড়ে থেকে সঠিক সংরক্ষণের অভাবে দেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হচ্ছে ।
কুমিল্লা হাওইয়ে পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহ বলেন, আমাদের প্রতিটি হাইওয়ে দুঘর্টনায় জব্দকৃত গাড়ি রাখার জন্য নিজস্ব ডাম্পি ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়ার অতিরিক্ত গাড়ির রাখার জন্য চান্দিনা কাঠেরপুল ও দাউদকান্দি ফায়ার সার্ভিস মাঠে ডাম্পি ব্যবস্থা রয়েছে। থানার ভেতরে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা না থাকায় অনেক সময় মামলার আলমতগুলো রাস্তার পাশে রাখা হয়।
কুমিল্লা পুলিশ সুপার বলেন আব্দুল মান্নান বলেন, পুলিশের জব্দ ও আদালতে পরিবহন গুলো দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন থানায় পড়ে আছে। এতে বিশেষ করে থানা পুলিশ সদস্য ও সেবাগ্রহীতাদের বেশ সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি কাজ শুরু করেছি। যেগুলো পুলিশের জব্দকৃত কিংবা আদালতের আলামত সেগুলো চিহ্নিত করে নিলামের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমরা বিষয়টি আদালতকে অবগত করেছি। এছাড়া পুলিশ বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি আমরা সত্যতা নিশ্চিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো ।