পাওনাদার পাট ব্যবসায়ীরা জানান, কোম্পানিটি ২০২০ সালে দখলে নেন নোমান চৌধুরী ও তাঁর ছেলে সালমান আহমেদ চৌধুরী। এরপর থেকে তাঁরা সরবরাহকারীদের পাওনা পরিশোধ করছেন না।
পাওনাদার সাহা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী সুশীল কুমার সাহা
মনিরুজ্জামান মনির ২০০২ সাল থেকে পাট খাতের একজন উদ্যোক্তা। দাহমাশী জুটের পাশাপাশি প্রাইড জুট ও গোল্ডেন জুট নামে তাঁর আরও দুটি পাটকল রয়েছে। বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যানও তিনি। আর নোমান চৌধুরী বিদেশে লোক পাঠানোর ব্যবসা করেন। তিনি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের প্রথম সহসভাপতি।
দাহমাশী কোম্পানিতে মালিকানা নিয়ে জটিলতা শুরু হয় ২০২০ সালের অক্টোবরে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও এমডির যৌথ স্বাক্ষরে ব্যাংক হিসাব পরিচালিত হলেও চেয়ারম্যান ওই সময় থেকে চেকে স্বাক্ষর করছিলেন না। ফলে টাকা পাচ্ছিলেন না পাট সরবরাহকারীরা।
একই বছরের ডিসেম্বরে মনিরুজ্জামান মনির ও মেহেদী জামানকে র্যাব কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে নোমান চৌধুরী সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেন। সেখানে বলা হয় তাঁরা কোম্পানি ছেড়ে যাবেন। প্রথমে কোম্পানি ছাড়তে রাজি হলেও মালিকানার ভাগ-বাঁটোয়ারার টাকা না পেয়ে শেয়ার লিখে দেননি তাঁরা।
কোম্পানির এমডি মনিরুজ্জামান মনির বলেন, পাওনাদারেরা টাকা পান কোম্পানির কাছে। টাকা আদায়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেছেন পাওনাদারেরা। অনেক পাওনাদার নোমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন।
জানান, তিনি ১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা পাচ্ছেন না। অথচ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ করে তিনি পাট সরবরাহ করেছিলেন। এখন পাওনাদারদের উৎপাতে তাঁকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
রিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার কামারখালীতে ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত শতভাগ রপ্তানিমুখী পাটসুতা উৎপাদনকারী কারখানা দাহমাশী জুট ইন্ডাস্ট্রিজ। কারখানাটিতে বিভিন্ন সময়ে কাঁচা পাট সরবরাহ করে ৪৩ জন পাট ব্যবসায়ী তাঁদের পাওনা আদায়ে মালিকদের পেছন পেছন ঘুরছেন।
এসব পাট ব্যবসায়ীর পাওনা ১৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। চেয়ারম্যান নোমান চৌধুরী তিন মাসের মধ্যে পাওনা পরিশোধ করবেন বলে লিখিত ওয়াদা করেও কথা রাখেননি। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ওয়াদা করেছিলেন।
একইভাবে এম বি ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মনিরুজ্জামান ১৪ লাখ, বিশ্বাস জুট ট্রেডার্সের আমিনুর রহমান ৩৯ লাখ, পাল ট্রেডার্সের কল্যাণ কুমার পাল ২৭ লাখ এবং আজাদ ট্রেডার্সের আবুল কালাম আজাদ দাহমাশী জুটের কাছে পান ২২ লাখ টাকা।
কল্যাণ কুমার পালবলেন, যত দিন মনিরুজ্জামান মনির কোম্পানির এমডি ছিলেন, তত দিন টাকা পেতে সমস্যা হয়নি। অন্য তিনজনও একই রকমের অভিযোগ করেছেন।
নোমান চৌধুরী অবশ্য গতকাল বলেন, পাওনাদারেরা তাঁর কাছে কোনো টাকা পাবেন না, পাবেন মনিরুজ্জামানের কাছে। তিনিই তাঁদের টাকা দেবেন। অর্থ পরিশোধে লিখিত দেওয়ার কথাও তিনি অস্বীকার করেন। বলেন, পাট খাতে বিনিয়োগ করাই তাঁর ভুল হয়েছে।
নিরুজ্জামান মনিরের অভিযোগ, মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করে মোস্তফা কামাল অ্যান্ড কোম্পানি নামক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে একটি স্বতন্ত্র নিরীক্ষা করান নোমান চৌধুরী। এরপর ৪৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আমিসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ১ মার্চ গুলশান থানায় মামলা করেন তিনি।
মামলা এখন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের তদন্তাধীন। অথচ ভুয়া নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরির দায়ে মোস্তফা কামাল অ্যান্ড কোম্পানির কার্যক্রম স্থগিত করেছে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্টস বাংলাদেশ (আইসিএবি)।
আইসিএবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শুভাশীষ বোস মোস্তফা কামাল অ্যান্ড কোংকে ২০২১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর চিঠি পাঠিয়ে বলেন, দাহমাশী জুটের ওপর ২০১৯-২০ সময়ের জন্য করা প্রতিবেদনটি সন্দেহজনক। এর সত্যতা নিশ্চিত হওয়া দরকার।
এদিকে কারখানা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারির আবেদন জানিয়ে ফরিদপুর জেলা আদালতে মনিরুজ্জামান মনিরসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ১৯ জুলাই অভিযোগ দায়ের করেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক সালমান আহমেদ চৌধুরী। ওই অভিযোগে বলা হয়, তিনি নিজে ও তাঁর বাবা নোমান চৌধুরী এবং মা শাহনাজ পারভীন কোম্পানিটির পরিচালক। মনিরুজ্জামান মনির ও তাঁর ছেলে মেহেদী জামান ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্বর তাঁদের শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন।
যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) থেকে সম্প্রতি সত্যায়িত তথ্য সংগ্রহ করে দেখা যায়, নোমান চৌধুরী, সালমান আহমেদ চৌধুরী এবং মনিরুজ্জামান ও মেহেদী জামান—এ চারজনই দাহমাশী জুটের পরিচালক।চারজনের বাইরে কেউ যদি কোম্পানির পরিচালক হিসেবে নাম ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়।