নন-ক্যাডার নিয়োগ নিয়ে কথা বলতে চাইলে পিএসসির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন বলেন, নন-ক্যাডার নিয়ে সৃষ্ট সমস্যায় পিএসসির কোনো হাত নেই। সরকারের আইনকানুন অনুসরণ করে নন-ক্যাডার নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করে পিএসসি।
নন-ক্যাডার নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) একধরনের অনীহা দেখা গেছে। বিগত ২৮তম বিসিএস থেকে এক পদ্ধতিতে নন-ক্যাডার নিয়োগ দেওয়া হলেও এখন সেই পথে হাঁটছে না সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। বরং আইন অমান্যের কথা বলে নন-ক্যাডার নিয়োগ সংকুচিত করা হচ্ছে।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/প্রতিষ্ঠান পিএসসিতে পৃথকভাবে চাহিদা পাঠালেও ক্যাডারের মতো এককভাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নন-ক্যাডারের শূন্য পদ পাঠানোর দায়িত্ব নিয়েছে। ফলে আগামী বিসিএস নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হবে বলে জানিয়েছেন পিএসসির সংশ্লিষ্টরা।
৩৫তম বিসিএস থেকে ৩৮তম বিসিএস পর্যন্ত যত নন-ক্যাডার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তা বিধিবহির্ভূত বলে মনে করছে কমিশন। যদিও বর্তমান কমিশনের বিধিবহির্ভূত আখ্যায়িত আইনের অধীনেই ৩৮তম বিসিএস থেকে প্রথম শ্রেণির নন-ক্যাডার নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। আগামী দিনে আইনের বাইরে গিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না—এমনটাই অভিমত কমিশনের। তবে ২৮তম বিসিএস থেকে ৪৪তম বিসিএস পর্যন্ত কোনো বিসিএসেই নন-ক্যাডারের পদসংখ্যা উল্লেখ ছিল না।
তার পরও এই বিধিবহির্ভূত কার্যক্রমের বৈধতার কথা বলে গত ২৩ আগস্ট পিএসসি থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এ-সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়েছে, বিসিএসে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগের আগে যত শূন্য পদই আসুক, তা একটি বিসিএসে নিয়োগ দিয়ে শেষ করা যাবে না। কোন শূন্য পদ কোন বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সময় এসেছে, তা বিবেচনায় আনতে হবে। এখন থেকে নতুন বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাডার পদের পাশাপাশি নন-ক্যাডার পদের সংখ্যাও উল্লেখ থাকবে। চলমান ৪০, ৪১, ৪৩ ও ৪৪তম বিসিএসের ক্ষেত্রে কোন বিসিএসের সময় কোন শূন্য পদের চাহিদা এসেছে, তা পর্যালোচনা করে মেধার ভিত্তিতে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগের সুপারিশ করা হবে। নন-ক্যাডার সুপারিশ করা হবে বিসিএস-এর বিজ্ঞপ্তির তারিখওয়ারি—এই চিঠিতে হতাশা ও ক্ষুব্ধ হন চাকরিপ্রার্থীরা। এরপর থেকে পিএসসির সামনে লাগাতার আন্দোলন করে যাচ্ছে নন-ক্যাডার পদপ্রত্যাশীরা।
সংকটের সমাধান বর্তমান বিধিতেই : বর্তমান নন-ক্যাডার বিধিমালাটি অকার্যকরের চেষ্টা চলছে। অথচ বর্তমান বিধিতে বিদ্যমান সংকটের সমাধান আছে। বিগত ড. সাদাত হোসাইনের নেতৃত্বাধীন কমিশন ২৮তম বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করে পিএসসি। ২০১০ সালের ১০ মে যখন নন-ক্যাডার নিয়োগ (বিশেষ) বিধিমালা হয় তখনই নন-ক্যাডার নিয়োগের পাশাপাশি বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিতে নন-ক্যাডারের পদ উল্লেখ করার বিধান ছিল। তবে বিধিমালা করার সঙ্গে সঙ্গে বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাডার ও নন-ক্যাডারের পদ উল্লেখ না করলেও সরকারের অনুরোধ সাপেক্ষে ৩০তম বিসিএস পর্যন্ত নন-ক্যাডার নিয়োগের সুপারিশ করতে পারবে বলে পিএসসিকে বিশেষ আইনি সুরক্ষা দেওয়া হয়।
পরবর্তীকালে ২০১৪ সালের ১৬ জুন নন-ক্যাডার নিয়োগ বিধিমালা সংশোধন করে প্রথম শ্রেণির পাশাপাশি দ্বিতীয় শ্রেণির সুপারিশের সুযোগ দেওয়া হয়। তখন আবার ২৮তম বিসিএস থেকে ৩৪তম বিসিএস পর্যন্ত বিজ্ঞপ্তিতে পদ উল্লেখ না থাকলেও সরকারের অনুরোধ সাপেক্ষে বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার নিয়োগের সুপারিশ করতে পারবে পিএসসি বলে বিধিতে উল্লেখ করা হয়। ৩৪তম বিসিএসের নন-ক্যাডার নিয়োগের পর পিএসসি থেকে ২০১৮ সালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে নন-ক্যাডার নিয়োগ বিধিমালা সংশোধন করে ৪০তম বিসিএস পর্যন্ত বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ না থাকলেও পূর্বের নিয়মে নন-ক্যাডার নিয়োগের বিশেষ সুবিধা চাওয়া হয়। একই সঙ্গে প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণির পরিবর্তে নন-ক্যাডার হিসাবে ৯ম, ১০ম, ১১তম এবং ১২তম গ্রেডের কথা বিধিতে সংযোজন করা হয়। তৎকালীন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফয়েজ আহম্মদ (বর্তমান পিএসসির সদস্য) বিধি সংশোনের প্রস্তাব পর্যালোচনা করে কিছু সুপারিশসহ পিএসসিতে ফেরত পাঠান।
তৎকালীন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মো. হেলালুজ্জামান সরকার স্বাক্ষরিত সেই বিধি সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাবে বিজ্ঞপ্তিতে পদ সংখ্যা উল্লেখের পরিবর্তে ‘প্রার্থী কর্তৃক নন-ক্যাডার পদের জন্য প্রদত্ত চাকরির পছন্দক্রম এবং মেধার ভিত্তিতে নন-ক্যাডার পদে চাকরির জন্য কমিশন সুপারিশ করবে’ প্রতিস্থাপন করেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সেই বিধিসংশোধনীর খসড়া প্রস্তাবনা ২০১৯ সালের শেষের দিকে পিএসসি থেকে সচিব কমিটির কাছে পাঠানো হয়। যেটি আজ পর্যন্ত অনুমোদন হয়নি। যদিও এরপর করোনা মহামারির কারণে সব কার্যক্রম থমকে যায়। পিএসসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সচিব কমিটিতে পাঠানো পিএসসির পূর্বের বিধিমালা সংশোধনী প্রস্তাবনাটি পাশ করলেও সব সংকটের সমাধান হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বর্তমান পিএসসির সদস্য ও সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফয়েজ আহম্মদ বলেন, এ ধরনের কোনো প্রস্তাবনা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে পিএসসিতে পাঠানো হয়েছিল কি না তা আমার মনে নেই।
জটিলতা-দীর্ঘসূত্রতা হবে বিসিএসে :নন-ক্যাডার জনপ্রশাসনের দায়িত্ব দিলে জটিলতা বাড়বে বলে মনে করছেন পিএসসির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মূলত পিএসসিকে ক্যাডার পদের চাহিদা পাঠিয়ে থাকে। এখন থেকে যদি নন-ক্যাডার পদে চাহিদাপত্রও প্রেরণ করে তাহলে বিসিএসে জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হবে।
জনপ্রশাসনের হাতে নন-ক্যাডারের দায়িত্ব দেওয়ার মাধ্যমে পিএসসির অনীহাও স্পষ্ট হয়েছে। যদিও ইতিমধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৪০, ৪১, ৪৩ ও ৪৪তম বিসিএস পর্যন্ত কোন বিসিএসে কত জন নিয়োগ দিতে পারবে পিএসসি তার একটি তালিকাও প্রেরণ করেছে। সেই তালিকা অনুযায়ী দ্রুত সময়ের মধ্যে ৪০তম নন-ক্যাডার নিয়োগের সুপারিশ করতে যাচ্ছে পিএসসি। জনপ্রশাসনের মাধ্যমে নন-ক্যাডারের কার্যক্রম পরিচালিত হলে দীর্ঘমেয়াদি সংকট তৈরি হবে। আগামী দিনে মাত্রারিক্তভাবে কমে যাবে নন-ক্যাডার নিয়োগ।
আন্দোলন থামাতে দ্রুত সুপারিশ :চলমান নন-ক্যাডার আন্দোলন থামাতে দ্রুত ৪০তম বিসিএসের নন-ক্যাডার নিয়োগের সুপারিশ করা হবে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। তারা বলছেন, সংকটের সমাধান না করে পিএসসি দ্রুত ৪০তম বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার নিয়োগ কার্যক্রম শেষ করতে চাচ্ছে।
এ বিষয়ে পিএসসির একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলেন, নন-ক্যাডার বিধিমালায় কী ধরনের সংশোধনী আনা হবে তার ওপর নির্ভর করছে পিএসসির নন-ক্যাডার নিয়োগ কার্যক্রম। বিধি সংশোধনী না হওয়া পর্যন্ত নন-ক্যাডার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারবে না। বর্তমানে নন-ক্যাডার নিয়োগ বিধিমালার সংশোধনী প্রস্তাবটি সচিব কমিটি রয়েছে। দ্রুত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
নন-ক্যাডার ও পিএসসি মুখোমুখি :পরিকল্পিতভাবে পিএসসি এবং নন ক্যাডার পদপ্রত্যাশীদের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। পিএসসির একটি বিশেষ মহল বিসিএসের মাধ্যমে নন-ক্যাডার নিয়োগ কার্যক্রম চান না। বরং নন-ক্যাডার নিয়োগের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ দেওয়ার পক্ষে তারা। বর্তমান ১১ নম্বরে উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীরাই বিসিএসে ক্যাডার না পেলে নন-ক্যাডার হিসেবে নিয়োগ পান। আলাদা পরীক্ষা নেওয়া হলে সেটি বড় জোর ৫০০ নম্বরের হবে। এতে করে পিএসসির একটি মহলের বাড়তি আয়ও হবে। পিএসসিতে ‘যত পরীক্ষা তত আয়’ একটি প্রবাদ চালু রয়েছে।
বিগত সময়ে যেভাবে নিয়োগ হতো : গত কয়েকটি বিসিএসে মেধার ভিত্তিতে ক্যাডার পদে নিয়োগের পর উত্তীর্ণ বাকি প্রার্থীদের নন-ক্যাডার হিসেবে অপেক্ষমাণ তালিকায় রাখা হয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়ে তাদের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শূন্য পদের সংখ্যা কত, তা পিএসসিতে পাঠানোর অনুরোধ করা হতো। সেখান থেকে পাঠানো পদের চাহিদা অনুযায়ী মেধার ভিত্তিতে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগের সুপারিশ করা হতো। নতুন আরেকটি বিসিএসের ফল প্রকাশের আগ পর্যন্ত শূন্য পদের চাহিদা এলে পিএসসি অপেক্ষমাণ প্রার্থীদের মধ্য থেকে যোগ্যদের নিয়োগের সুপারিশ করত। সর্বশেষ গত ৩৮তম বিসিএস থেকে প্রায় ৩ হাজার ৩০২ জন চাকরিপ্রার্থীকে বর্তমান কমিশনই এই নিয়মে নিয়োগের সুপারিশ করে।