২০২১ সালের ‘কপ-২৬’ সম্মেলনের আয়োজক ছিল যুক্তরাজ্য। সেখানে তারা বড় প্রতিশ্রুতি রেখেছিল এবং জলবায়ু প্রশ্নে নিজেদের নেতৃত্বের ভূমিকায় দেখিয়েছিল। কিন্তু এবার তা হচ্ছে না।ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের গ্র্যান্থাম ইন্সটিটিউটের পলিসি ডিরেক্টর অ্যালিসা গিলবার্টের বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, হতাশাজনক ও দুর্বল একটি চেহারা নিয়ে ‘কপ-২৭’ সম্মেলনে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য।জলবায়ু সঙ্কট এড়াতে নিজেদের ভূমিকা নিয়ে নতুন কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি যুক্তরাজ্য। বরং বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের কারণে উত্তর সাগরে নতুন করে তেল ও গ্যাস উত্তোলন বন্ধ করা এবং কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধের প্রতিশ্রুতি থেকে পিছিয়ে গেছে দেশটি।
‘কপ-২৭’ সম্মেলনে যোগ দিতে মিশরে আসছেন বিশ্ব নেতারা। জলবায়ু পরিবর্তনে প্রধান ভূমিকা রাখা সাতটি দেশের মধ্যে কেউ বিপর্যয় এড়ানোর চেষ্টায় নেতৃত্ব দিচ্ছে, আর কেউ পেছন থেকে টেনে ধরছে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
জলবায়ু সঙ্কটের সঙ্গে লড়তে সুদূরপ্রসারী ‘ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট’ নতুন আইন পাসের মাধ্যমে এ বছর বড় পদক্ষেপ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ুমণ্ডলকে উষ্ণ করে দেওয়া গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন ৪০ শতাংশ কমে আসতে পারে।ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইন্সটিটিউটের মার্কিন পরিচালক ড্যান লাশফের বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে জলবায়ু সঙ্কটের সমাধানে এটি সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। অগ্রগতির একটি বড় লক্ষণ এটি।
মার্কিন এই আইনের লক্ষ্য বিদ্যুৎ, পরিবহন এবং শিল্পের মত প্রধান খাতে পরিবেশ বান্ধব জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি। কেউ একটি বৈদ্যুতিক গাড়ি কিনলে করের ক্ষেত্রে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার ডলার ছাড় পেতে পারেন।কিন্তু মার্কিন স্পিকারের বিতর্কিত তাইওয়ান সফরের পর জলবায়ু প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতার হাত ফিরিয়ে নিয়েছে চীন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তার ন্যায্য অংশও দেয়নি, এরফলে ‘কপ-২৭’ সম্মেলনে টানাপোড়ন বাড়াতে পারে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ঐতিহাসিকভাবে প্রগতিশীল। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ও জ্বালানি সরবরাহের সঙ্কট ইইউর সেই ভূমিকায় পরিবর্তন এনেছে।ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকারের মতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা, নীতি ও অর্থায়ন এখন অপ্রতুল। ইইউ তাদের নতুন ক্লাইমেট অ্যাকশন প্ল্যানের হালনাগাদ অবস্থা জাতিসংঘে এখনও জানায়নি। ‘রি-পাওয়ার ইইউ’ নামের এই নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে ইইউর।
এ বছর যেসব দেশ হালনাগাদ জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা প্রকাশ করেছে, ভারত তাদের অন্যতম। লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সের কাম্য চৌধুরী জানান, অগ্রগতির কথা না বলে ভারতের বিষয়ে কথা বলা প্রায় অসম্ভব।২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমনের মাত্রা ৪৫ শতাংশ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত। দেশের অর্ধেক জ্বালানি নবায়নযোগ্য উৎস থেকে যোগান দেওয়ার সামর্থ্যে পৌঁছাতে চায় দেশটি।
কিন্তু ভারতের ১০০টি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুনরায় চালু করার পরিকল্পনা সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা অর্জনের পথে একটি বিশাল বাধা বলে মনে করেন সেন্টার ফর পাবলিক পলিসি এবং জাতিসংঘের জলবায়ু উপদেষ্টা অধ্যাপক নভরোজ দুবাশ। তবে অন্য দেশের মতো ভারতের ক্ষেত্রেও কয়লায় ফেরাকে সঙ্কট সমাধানের স্বল্পমেয়াদী ব্যবস্থা হিসেবে দেখছেন কাম্য চৌধুরী।
ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকার অবশ্য জানিয়েছে, ভারতের জলবায়ু অঙ্গীকারগুলো যতটা বলা হচ্ছে, ততটা উচ্চাভিলাষী আসলে নয়। সরকারের কিছু পদক্ষেপেই সেটা অর্জন করা সম্ভব।জলবায়ু পরিবর্তনের লড়াইয়ে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ ব্রাজিল। কারণ এই গ্রহের ফুসফুস নামে পরিচিত বিশাল রেইনফরেস্ট অ্যামাজন রয়েছে সেখানে। প্রচুর পরিমাণে কার্বন শোষণ করে এই বন।
গত সপ্তাহে এক নাটকীয় নির্বাচনে জাইর বলসোনারোকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন লুলা দা সিলভা। নেতৃত্বের এই পরিবর্তনে অ্যামাজনেরও ভাগ্য পরিবর্তন হতে পারে বলে ধারনা করা হচ্ছে। নির্বাচিত হয়েই লুলা জানান, ব্রাজিল জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার নেতৃত্বের ভূমিকা পুনরায় গ্রহণ করতে প্রস্তুত।কেবল ২০২১ সালেই অ্যামাজনে বন উজাড়ের হার বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। এর মূল কারণ ছিল অ্যামাজনে খনিজ সম্পদ উত্তোলনে বলসোনারোর উৎসাহ। গ্লাসগোর ‘কপ-২৬’ সম্মেলনের পর ব্রাজিলের জলবায়ু প্রতিশ্রুতি নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে।
ব্রাজিল প্রচুর পরিমাণে পরিবেশ বান্ধব পানিবিদ্যুৎ ব্যবহার করে আসছিল। কিন্তু ২০২১ সালের খরায় পানি শুকিয়ে গেছে। ফলে দেশটি তেল ও গ্যাস ব্যবহার বাড়িয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ব্রাজিলে তেলের ব্যবহার ৭০ শতাংশ বেড়ে পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।তবে আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা জানিয়েছে, যেসব দেশ পানিবিদ্যুৎ নিয়ে সমস্যায় পড়েছে, সৌরশক্তি তাদের সেই ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারে।
মে মাসে অস্ট্রেলিয়ার নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন অ্যান্টনি আলবানিজ। গত এক দশকে পিছিয়ে পড়ার পর এখন তিনি আবার জলবায়ু পরিকল্পনাগুলো বাড়াচ্ছেন। দেশটি ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৩ শতাংশ কার্বন নির্গমন কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে জাতিসংঘের কাছে নতুন লক্ষ্য পেশ করেছে। আগের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৬ শতাংশ।
ক্লাইমেট অ্যানালিটিক্সের প্রধান নির্বাহী সিইও বিল হেয়ার জানান, অনেক পিছিয়ে থাকার কারণেই অস্ট্রেলিয়ার এই অঙ্গীকারকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বলে মনে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার নীতিতে পরিবর্তন হয়েছে সামান্যই, আর সেটা জীবাশ্ম জ্বালানির ক্ষেত্রেও হয়নি।
অস্ট্রেলিয়ার রাজ্যগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বাড়াচ্ছে। তবে এখনও দেশটি বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি কয়লা উৎপাদক দেশের একটি। অস্ট্রেলিয়া ‘কপ-২৬’ সম্মেলনে বন উজাড় বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ২০২১ সালে এই প্রতিশ্রতি দেওয়া একমাত্র উন্নত দেশ তারা। অস্ট্রেলিয়া গাছ ধ্বংসের জন্য হটস্পট। পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার প্রায় অর্ধেক বন ধ্বংস হয়ে গেছে।
বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটে চীনের একটি জটিল ভূমিকা রয়েছে। গ্র্যান্থাম ইন্সটিটিউটের জ্বালানি ও প্রশমন বিভাগের সিনিয়র পলিসি ফেলো নেইল হার্স্ট ব্যাখ্যা করেছেন, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মতো চীন গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে দায়ী না হলেও, খুব দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পাওয়ার চেষ্টায় ভয়ঙ্কর দূষণকারী দেশে পরিণত হয়েছে।
বিশ্বের অর্ধেক কয়লা পোড়ায় চীন। জ্বালানি সংকটের কারণে সেটা বন্ধ করতেও নারাজ তারা। তবে হার্স্ট জানান, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে চীন এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী। চীনে নতুন নিবন্ধিত গাড়ির এক চতুর্থাংশ বৈদ্যুতিক। তারা বড় ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছে এবং লক্ষ্য নির্ধারণ করছে যে ২০৩০ সালের পর কার্বন নির্গমনের হার তারা আর বাড়তে দেবে না বলে জানান তিনি।গাছ লাগানোর মাধ্যমেও কার্বন নিঃসরণ মোকাবেলার বড় উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে চীনের। গত মে মাসে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ২০৩০ সালের মধ্যে ৭০ লাখ বিলিয়ন গাছ লাগানোর অঙ্গীকার করেছেন।