দেশের সংকটকালে সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা।বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাস রেমিট্যান্সপ্রবাহ ইতিবাচক ধারায় ছিল। পরবর্তী সময়ে রেমিট্যান্সের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি রিজার্ভে বড় প্রভাব ফেলে। গত অক্টোবরে ১৫২ কোটি ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা, যা গত আট মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবর মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ৭.৮৫ শতাংশ।
দেশে ডলার সংকট মোকাবেলায় রেমিট্যান্স (প্রবাস আয়) আহরণে আরো জোর দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু রেমিট্যান্সে ভাগ বসাচ্ছে হুন্ডি। অনিরাপদ এই মাধ্যমে ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার কিছুটা বেশি পাওয়ায় প্রবাসী কর্মীদের একটি অংশ হুন্ডিতে ঝুঁকছে। অবৈধ এই মাধ্যমে নগদ ডলার দেশে না আসায় ডলারের সরবরাহ কমছে, টান পড়েছে রিজার্ভে।
বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানো উৎসাহিত করতে সম্প্রতি চার্জ তুলে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এতে বড় কোনো সুফল আসবে বলে মনে করছেন না খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, রিজার্ভ না বাড়লে অর্থনীতি স্বাভাবিক হবে না। তাই রেমিট্যান্স আহরণ বাড়াতে নগদ প্রণোদনার পরিমাণ বাড়ানো, প্রক্রিয়া আরো সহজ করা, খোলাবাজারের সঙ্গে ব্যাংকিং চ্যানেলের বৈদেশিক মুদ্রার পার্থক্য কমানো, হুন্ডি প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের এখন আরো প্রণোদনা দিয়ে দ্রুত রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। এটাই সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে আপাত সমাধান। মধ্য মেয়াদে অবশ্যই রপ্তানি বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। রপ্তানিকারকরা যাতে আরো বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আনতে পারে তার জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আর হুন্ডি হাওলা নিরুৎসাহ করার পাশাপাশি মুদ্রাপাচার রোধে আরো শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। ’
ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ২৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কমায় রিজার্ভ কমেছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বাড়াতে বাজারে ডলার ছেড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসেই ৫০০ কোটি (পাঁচ বিলিয়ন) ডলারের বেশি বিক্রি করা হয়েছে। গত অর্থবছরে বিক্রি করা হয়েছিল ৭৬২ কোটি ডলার। গত বৃহস্পতিবার রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৪.২৬ বিলিয়ন ডলার।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের হিসাব নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের যে তথ্য প্রকাশ করছে, প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ তা থেকে আট বিলিয়ন ডলার কম। সেই হিসাবে রিজার্ভ এখন ২৬ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারও সেটি মেনে নিয়ে বলেছেন, গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ৩৪.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর থেকে আট বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে যা থাকে সেটিই হচ্ছে নেট রিজার্ভের পরিমাণ। ফলে বর্তমানে নেট রিজার্ভের পরিমাণ ২৬.৩ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক জি এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনীতির বহিঃখাতে (এক্সটারনাল সেক্টর) অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। এ জন্য বিশ্ব অর্থনীতিতে এখন টালমাটাল অবস্থা। এই অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে সরবরাহ ও চাহিদার ব্যত্যয় ঘটতে থাকে। বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষজ্ঞ টিম কাজ করছে। এ ছাড়া রেমিট্যান্স প্রেরণে চার্জ মওকুফসহ নেওয়া হয়েছে একগুচ্ছ পদক্ষেপ। এতে শিগগিরই রেমিট্যান্স বাড়বে বলে আশা করছি। ’তিনি বলেন, ‘চলমান পরিস্থিতিতে আমরা রেমিট্যান্স আরো বাড়ানোর দিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছি। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া পদক্ষেপগুলো হচ্ছে অনিবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বিনিয়োগ ও গৃহায়ণে অর্থায়নের সুবিধা বাড়ানো, ফিনটেক পদ্ধতির আওতায় আন্তর্জাতিক মানি ট্রান্সফার অপারেটরকে বাংলাদেশের ব্যাংকের সঙ্গে ড্রয়িং ব্যবস্থা স্থাপনে উদ্বুদ্ধ করা এবং রেমিট্যান্স প্রেরণে ব্যাংক বা এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর চার্জ ফি মওকুফ, বৈধ উপায়ে ওয়েজ-আর্নারস রেমিট্যান্সের বিপরীতে আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা, রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের সিআইপি সম্মাননা, রেমিট্যান্স বিতরণ প্রক্রিয়া সম্প্রসারণ ও সহজ করা।
চার্জের প্রভাব কতটুকু
রেমিট্যান্স পাঠাতে এখন থেকে আর চার্জ দিতে হবে না প্রবাসী বাংলাদেশিদের। একই সঙ্গে বিদেশে ছুটির দিনও রেমিট্যান্স পাঠাতে পারবেন তাঁরা। চলমান ডলার সংকটে বৈধভাবে রেমিট্যান্স বাড়াতে এসব উদ্যোগ নিয়েছে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি এবং বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাফেদা।সোনালী ব্যাংকের এমডি ও বাফেদার চেয়ারম্যান আফজাল করিম বলেন, এখন থেকে ব্যাংকগুলো ১০৭ টাকায় রেমিট্যান্স এবং ১০০ টাকায় রপ্তানি আয় সংগ্রহ করবে। পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশিদের সুবিধার্থে মওকুফ করা হয়েছে রেমিট্যান্স পাঠানোর চার্জ বা কমিশন ফি। কোনো ধরনের খরচ ছাড়া প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারবেন। একই সঙ্গে ছুটির দিনগুলোতেও এখন রেমিট্যান্স পাঠাতে পারবেন প্রবাসীরা।
পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘প্রবাসীদের বেশির ভাগই ছোট ছোট আকারের রেমিট্যান্স পাঠান। এতে খরচ খুব বেশি নয়। সেই চার্জ বিদেশি রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রতিষ্ঠান মওকুফ করবে না। শুধু যেসব ব্যাংকের বিদেশে নিজস্ব এক্সচেঞ্জ হাউস আছে তারা চার্জ মওকুফ করতে পারে। কিন্তু এই বিষয়ে এখনো কোনো নির্দেশনা জারি করা হয়নি। তার পরও উদ্যোগটি ভালো। খোলাবাজারের সঙ্গে বিনিময় হারের ব্যবধান কমাতে হবে। প্রক্রিয়া আরো সহজ করে প্রবাসীদের দোরগোড়ায় নেওয়া দরকার। ’ তিনি বলেন, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি যদি ধারাবাহিকভাবে নেতিবাচক থাকে তাহলে ডলারের জোগান শুধু আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে বাড়ানো যাবে না।