‘সন্ধ্যার পর এখানে এসে এক মিনিট দাঁড়ান, টের পাবেন কী পরিমাণ মশা! কয়েল বা এরোসল—কোনো কিছুতেই কাজ হয় না। বাচ্চারা টেবিলে বসতে পারে না, পড়াশোনা করে মশারির ভেতরে বসে। সিটি করপোরেশন সপ্তাহে এক দিন ওষুধ ছিটায়, কিন্তু মশা মরে না। ’ গত মঙ্গলবার এভাবে খেদ প্রকাশ করেন রাজধানীর মহানগর আবাসিক এলাকার বাসিন্দা খাইরুল ইসলাম জীবন।
তিনি বলেন, মশার উৎপাতে জীবন জেরবার। দেশে গত দেড় মাসে বৃষ্টি না হওয়ায় এডিস মশা কমলেও বেড়েছে কিউলেক্স মশা। রাজধানীর ধানমণ্ডি, বাংলামোটর, তেজগাঁও, গুলশানসহ বেশ কয়েকটি এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মশার ভয়ে বিকেল হতে না হতে দরজা-জানালা বন্ধ রাখতে হয়। এর পরও মশা থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না।
সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ঢাকার অভিজাত আবাসিক এলাকা বারিধারায়ও মশার উৎপাত থেকে তিনি রক্ষা পাচ্ছেন না। তিনি আশা প্রকাশ করেন, সিটি করপোরেশন থেকে নজরদারি বাড়ালে মশা কমে আসবে।ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস কিউলেক্স মশা জন্মানোর অনুকূল সময়। সাধারণত নর্দমা, ডোবা, নালা, খাল-বিল—এসব জায়গায় স্থির পানি এগুলোর প্রজননস্থল।ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, ‘মশার ওষুধ মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগের আগে ল্যাবে এর কার্যকারিতা ৯৮ শতাংশ নিশ্চিত করা হয়। এরপর আমরা তা প্রয়োগ করে থাকি। কাজেই ওষুধ নিয়ে বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই।
মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বলছে, এডিস ও কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে সারা বছরই তারা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে থাকে। বর্তমানে তারা নর্দমা ও নালায় কচুরিপানা এবং অন্যান্য ময়লা নিয়মিত পরিষ্কার করছে। একই সঙ্গে ফগার মেশিনের মাধ্যমে কীটনাশক ছিটানোর কাজ চলছে। ব্যবহৃত কীটনাশক ল্যাবে (পরীক্ষাগার) পরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেছে, তা ৯৫ শতাংশ কার্যকর। তবে মশা না কমায় নাখোশ নগরবাসী।
ধানমণ্ডির জিগাতলা এলাকার বাসিন্দা সাবিয়া আক্তার বলেন, ‘বিকেল হলেই মশার উপদ্রব বাড়তে থাকে। ওষুধ স্প্রে করলে দেখা যায় সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে ১০ মিনিট মশা কম থাকে। এরপর সেই আগের অবস্থা। সিটি করপোরেশন থেকে যে ওষুধ ছিটায়, এতে মশা কবে কমেছে, আমার জানা নেই। ’প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের ওষুধ পুরোপুরি কার্যকর। ডোবা, নালা, খাল-বিল—এসব জায়গায় আমাদের পরিষ্কারের কাজ অব্যাহত আছে। ফগিং কার্যক্রমও চলমান। আশা করি, দক্ষিণ সিটি এলাকায় মশা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান বলেন, ‘আমি নিজে উপস্থিত থেকে ওষুধের কার্যকারিতা ল্যাবে পরীক্ষা করিয়েছি। ৯৫ শতাংশের নিচে কাজ করে—এ পর্যন্ত এমন ওষুধ প্রয়োগ করিনি। বর্তমানে যে ওষুধ ব্যবহার করছি, সেটি দু-তিন বছরের বেশি হয়নি। ’তিনি বলেন, মশা না কমার প্রধান কারণ হলো অপরিকল্পিত নগরায়ণ। এর সঙ্গে রয়েছে ভাসমান জনগোষ্ঠীর পরিবেশদূষণ। মানুষ ময়লা ফেলে নর্দমা ভরে রাখে। আবর্জনা ফেলে খালগুলো ভরে রেখেছে আগেই। মশা নিধনে আগে প্রয়োজন জনসচেতনতা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, একটা জায়গায় মশা কয়েক কোটি ডিম পাড়ে। তখন যদি ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাহলে ছোট জায়গায় কোটি কোটি মশা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু এই মশাগুলো যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়, তখন যে পরিমাণ কীটনাশক দিতে হয়, এতে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের সমস্যা তৈরি করছে। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, একটা ভুল পথে যাচ্ছে সিটি করপোরেশন। অকার্যকর কীটনাশক ফগিং যতই করা হোক না কেন, এতে পরিবেশদূষণ হবে, মানুষের ক্ষতি হবে, কিন্তু মশা মরবে না। তাই আমাদের বিকল্প চিন্তা করতে হবে। ’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশা নিধনে ব্যবহৃত কীটনাশক শুধু মানুষ নয়, পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য বিপদ বয়ে আনছে। কারণ এই কীটনাশক সহজেই পানির সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। এতে ঝুঁকিতে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক মানুষ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। অতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগে হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সার, ফুসফুস ও কিডনির রোগের আশঙ্কা থাকে।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার কালের কণ্ঠকে বলেন, পরিবেশের বিভিন্ন সমস্যার কারণে মশার জন্ম হয়। মশা নিয়ন্ত্রণে তিনি চারটি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উল্লেখ করেন। তা হলো—১. পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মশার প্রজননস্থল কমানো; ২. উপকারী প্রাণীর মাধ্যমে মশা নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ; ৩. নির্দেশনা অনুযায়ী বিজ্ঞানসম্মতভাবে কীটনাশকের ব্যবহার এবং ৪. মশা নিয়ন্ত্রণে জনগণের অংশগ্রহণ।