শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৭:৩৬ অপরাহ্ন

রমজান মাস শুরুর আগেই ছোলা-খেজুরসহনিত্য পণ্যের বাজার অস্থির

প্রতিনিধির / ৬৩ বার
আপডেট : বৃহস্পতিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
রমজান মাস শুরুর আগেই ছোলা-খেজুরসহ নিত্য পণ্যের বাজার অস্থির
রমজান মাস শুরুর আগেই ছোলা-খেজুরসহ নিত্য পণ্যের বাজার অস্থির

প্রতি বছর রোজার মাসে বেশি চাহিদা থাকে তেল, চিনি, ছোলা, আদা, ডাল, খেজুর প্রভৃতি পণ্যের। রমজান মাস শুরুর বাকি এখনো প্রায় দুই মাস। অথচ এরই মধ্যে এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। অন্য নিত্যপণ্যের দামেও ঊর্ধ্বগতি। উদ্বেগ বাড়ছে নিম্ন আয়ের মানুষের। ব্যবসায়ীরা বলছেন, জ্বালানির দাম, ডলার ও এলসি সংকটে দাম বাড়ানো ছাড়া তাদের উপায় নেই।

বাজার পরিস্থিতি যাই হোক, এবারও রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে না বলে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে সরকারের বিভিন্ন মহল। কিন্তু রমজান শুরুর আগেই দ্রব্যমূল্যের আগাম ঊর্ধ্বগতির কারণে এমন আশ্বাসে ভরসা নেই জনগণের। তারা বলছেন, বিগত কয়েক বছরের মতো এ রমজানেও অসাধু ব্যবসায়ী চক্র পুরোনো ছকে চলছে। রমজাননির্ভর পণ্যের দাম তারা আগেই বাড়াতে শুরু করেছে, যাতে রমজানে নতুন করে বাড়ানোর প্রয়োজন না পড়ে।ব্যবসায়ীদের দাবি, বৈশ্বিক পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, ডলার সংকটে এলসি খোলায় সমস্যার কারণে সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে বাজারে। বাধ্য হয়ে তারা পণ্যমূল্য সমন্বয় করছেন। অস্বাভাবিকভাবে কোনো পণ্যের মূল্য বাড়ছে না।

রামপুরা জামতলা এলাকার ফরিদা ইয়াসমিন অনেক হিসাব করে সংসার চালান। মঙ্গলবার (৩১ জানুয়ারি) তিনি রমজানের কিছু পণ্য আগাম কিনে রাখার জন্য বাজারে গিয়েছিলেন, যাতে সে সময় সংসারে বাড়তি চাপ না পড়েন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, প্রতি রমজানে পণ্য কিনতে হিমশিম খেতে হয়। সেজন্য এবার গত বছরের অর্জিত ছুটির কিছু টাকা দিয়ে বাজার সেরে রাখতে চেয়েছিলাম। এসে দেখি রোজার জন্য আমার যা যা প্রয়োজন, সবকিছুর দাম বেশি।

তিনি বলেন, তেল, চিনি, আদা, রসুন, ছোলা, ডাল, খেজুরসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে। বেসনের দামও বেশি। কিন্তু রোজার জন্য প্রয়োজন নয়, এমন পণ্যের দাম কিন্তু বাড়ছে না। তাহলে এটাকে সিন্ডিকেট ছাড়া কী বলা যায়? প্রতি বছর একই ছক এঁকে ভোক্তার পকেট কাটা হচ্ছে।রমজানের পণ্যের দাম বাড়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন বিক্রেতারাও। খিলগাঁও রেলগেট বাজারে নোয়াখালী স্টোরের স্বত্বাধিকারী ফারুক খান জাগো নিউজকে বলেন, মুদিপণ্য যেগুলো রমজানে বেশি লাগে, সবকিছুর দামই এখন বেশি। শুধু তাই নয়, চিনি, তেলের মতো পণ্যগুলোর সরবরাহ সংকটের কথাও শোনা যাচ্ছে ইদানীং। ওই সময় পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে সেটা জানা নেই। তবে বাজার স্থিতিশীল থাকবে না সেটা নিশ্চিত।

রমজানে খেজুরসহ বেশকিছু ফলের চাহিদাও বাড়ে। কারওয়ান বাজারে ফল বিক্রেতা খালেক মন্ডল বলেন, খেজুরের দাম আরও দুই মাস আগে থেকে বাড়ছে। পাইকারি বাজারে অনেকে মজুত রাখছে। ছাড়ছে না। সে কারণে খুচরায় আগের তুলনায় প্রতি কেজি খেজুর মানভেদে ২০ থেকে ১০০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।তেল-চিনির দাম আগে বেড়েছে, এখন বাড়ছে ছোলা-ডালের
বাজারে দীর্ঘদিন ধরে তেল, চিনির দাম বাড়তি। গত সপ্তাহে চিনির দাম আরেক দফা কেজিতে পাঁচ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে প্রতি কেজি পরিশোধিত চিনির দাম (খোলা) পাঁচ টাকা বাড়িয়ে ১০৭ এবং পরিশোধিত চিনির (প্যাকেটজাত) দাম চার টাকা বাড়িয়ে ১১২ টাকা করা হয়েছে। যদিও বাজারে সেই দামেও চিনি মিলছে না। কিনতে হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকা কেজিতে।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ- টিসিবির তথ্য বলছে, গত বছরের তুলনায় এখন চিনির দাম ৫০ শতাংশ বেড়েছে। আর সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ১৪ থেকে ১৭ শতাংশ। পাম তেলের দাম বেড়েছে ১৮ শতাংশ। বছরের ব্যবধানে এখন মসুর ডালের দাম ১৭ শতাংশ ও ছোলার দাম ১৩ শতাংশ বেশি।এছাড়া এসময় পেঁয়াজের দাম না বাড়লেও গত বছরের একই সময়ে দেশে আদার দাম মানভেদে ৫০-১১০ শতাংশ, রসুনের দাম ৪৫-১২৭ শতাংশ এবং শুকনো মরিচের দাম ৭৫-১৫২ শতাংশ কম ছিল। খেজুরের দাম শতাংশে হিসাব না করে দেখালেও সংস্থাটি বলছে, কেজিতে ২০ টাকা বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ড. গোলাম রহমান  বলেন, আমাদের কিছু আমদানির সমস্যা হচ্ছে। তবে সেটা পুঁজি করে বাজারে তারচেয়েও বেশি অস্থিরতা তৈরির প্রচেষ্টা রয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।‘কয়েক বছর ধরে দেখা গেছে, ব্যবসায়ীরা রমজানে পণ্যের দাম খুব কম বাড়ান। রমজান আসার এক-দুই মাস আগেই দাম বাড়িয়ে দেন। বর্তমান বাজারে সবকিছুই বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। তাই রমজান আসার আগেই এ বিষয়টি নিয়ে কঠোর মনিটরিং করে সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা নিতে হবে। অযৌক্তিক মুনাফার লোভে সময়-সুযোগ বুঝে পণ্যের দাম বাড়িয়ে আসছে। সেগুলোর কঠিন মনিটরিং প্রয়োজন।’

তিনি আরও বলেন, ডলার সংকটের কারণে কতটা সমস্যা হচ্ছে সেটাও সরকারের উচিত বাজার গভীরভাবে পর্যালোচনা করে তদারকি করা। পাশাপাশি রমজান ঘিরে ভোক্তাদের সচেতন হতে হবে। পণ্য কিনে মজুত করা ঠিক হবে না। সংযত হয়ে বাজারে পণ্য কিনতে হবে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, সংকটের কারণে আমদানি-রপ্তানি ও সরবরাহ পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিয়মিত বাজার তদারকি এবং মনিটরিং করবে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। বাজার নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে। প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে তাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সেটা সমাধানের জন্য করা হচ্ছে সুপারিশ।তিনি বলেন, এ রমজানে খুচরা বাজারের পাশাপাশি মোকাম থেকে পাইকারি বাজার পর্যন্ত মনিটরিং করবো। অনিয়মের প্রমাণ মিললেই কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে।

যা বলছেন বড় ব্যবসায়ীরা
রমজানে একটি পরিবারের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় তেল, চিনি, ছোলা, ডাল, খেজুরের মতো পণ্যগুলো। যেগুলোর সবকটি পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। ডলার সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে পারছেন না। আমদানি করা পণ্যও খালাস করতে পারছেন না ডলারের অভাবে। এর মধ্যে দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচও বেড়েছে। তাই রমজানে ভোগ্যপণ্যের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।এ বিষয়ে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র সহকারী মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার  বলেন, বাজারে সরবরাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে ব্যবসায়ীদের সহায়তা দিতে হবে। কিন্তু এখন আমরা অনেক সংকটে। এর মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। সেগুলোও সমস্যা।

তিনি বলেন, আমদানি সংকট রয়েছে। অনেক সময় এলসি খোলা যাচ্ছে না। এলসি খুলে পণ্য বন্দর পর্যন্ত এনেও কোনো কোনো ব্যবসায়ী ডলার না থাকার কারণে বিল পরিশোধ করতে পারছেন না। কাঁচামাল সংকটে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন।নাম প্রকাশ না করার শর্তে অন্য একটি শিল্প গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, প্রতিটি কোম্পানি সেটুকু উৎপাদন করছে, যেটুকু দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে নেওয়া যায়। পরিস্থিতি খুব বেশি খারাপ। যাদের অবস্থা ভালো, তারা কেউ ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। আর অধিকাংশের সামর্থ্য নেই।

গত ডিসেম্বর থেকেই রমজানকেন্দ্রিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির এলসি খোলা শুরু হয়। তবে ডলার সংকটের কারণে নিত্যপণ্য আমদানি বিল পরিশোধে দেরি হচ্ছে। এলসি খোলায়ও দেখা দিয়েছে জটিলতা। অক্টোবর-ডিসেম্বরে এলসি খোলার হারও কমেছে।বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই সময়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের শেষ চার মাসে অপরিশোধিত চিনির এলসি আগের বছরের চেয়ে ২৮ শতাংশ কমেছে। এছাড়া অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ৪৭ শতাংশ, সয়াবিন ৮৩ শতাংশ, অপরিশোধিত পাম তেল ৯৯ শতাংশ, ছোলা ৪৭ শতাংশ ও খেজুর আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৩০ শতাংশ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শীর্ষ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য বন্দরে আটকা পড়ে রয়েছে এলসি বিল পরিশোধ না করতে পারার কারণে। তাদের পণ্য খালাস করা হচ্ছে না। এতে তাদের বাড়তি জাহাজ ভাড়াও গুনতে হচ্ছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ