দেশের ৪৮টি নদী দখলদারদের তালিকা করতে ২০১৮ সালে ৩৩ কোটি টাকা খরচ করে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। তালিকাটি চূড়ান্ত করে ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু তালিকাটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হচ্ছে না। কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান হাওলাদার অভিযোগ করেছেন, কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরীর আত্মীয়স্বজন এবং তার সহযোগীরাই নদী দখলের সঙ্গে জড়িত। এসব দখলদারকে আড়াল করতে তিনি দখলদারদের তালিকা বাতিল করে দিয়েছেন। জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে নদী রক্ষা কমিশন এ তালিকা তৈরি করেছিল। সম্প্রতি এক কর্মশালায় বক্তব্য দিতে গিয়ে মুজিবর রহমান হাওলাদার এমন অভিযোগ করেন।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মনজুর আহমেদ চৌধুরী। মুজিবর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘কমিশন থেকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এবং দেশের আইন মেনে দখলদারদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু চেয়ারম্যান ঐ তালিকা প্রকাশ না করে পুনর্মূল্যায়নের নামে তালিকা থেকে অনেক দখলদারের নাম বাতিল করতে চান। দখলদারের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য আর্থিক সুবিধা নেওয়ার কথাও আমরা শুনতে পাচ্ছি।’মুজিবর রহমান হাওলাদার অভিযোগ করেন, সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী আমাকে একদিন বললেন, ‘আপনার মাঠপর্যায়ে গিয়ে তালিকা করার দরকার নাই। ঢাকায় বসে কাজ করলেই চলবে।’ কিন্তু আমি ঐ মন্ত্রীর এলাকায় গিয়ে দেখি তার বাবার আমল থেকে দুটি শিল্পকারখানা নদী দখল করে চালানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘অনেক সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান ও প্রভাবশালী নেতা নদী দখল করে আছেন। তাদের নাম বাদ দিতে বর্তমান চেয়ারম্যান দখলদারদের তালিকা সংশোধন করছেন।’নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, ‘দেশে নদী যে দখল ও দূষণের শিকার হচ্ছে, তা বুঝতে বিজ্ঞান ও গবেষণার দরকার হয় না। নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও বোঝা যায়। নদী রক্ষা কমিশনের কাজ ছিল ইতিমধ্যে চিহ্নিত হওয়া দখলদারদের উচ্ছেদে উদ্যোগ নেওয়া। যাদের নদী দখলদারদের তালিকা যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, তাদের সম্পদের হিসাব নিলে ঐ তালিকা সংশোধনের আসল কারণ বেরিয়ে আসবে। শুধু তাই নয়, নিয়োগপত্রের শর্তও তিনি রাখেননি।’
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০১৩ এর ধারা ৫(২) এবং একই আইনের ধারা ৫(৩) অনুযায়ী ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরীকে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সঙ্গে কর্ম সম্পর্ক পরিত্যাগের শর্তে নিয়োগ দেওয়া হলেও তিনি সেই শর্ত ভঙ্গ করে নদী দখল করে গড়া আত্মীয়দের দ্বারা পরিচালিত মিল, কারখানা তথা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। অন্যদিকে তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়ার পর নিজেকে প্রমাণ করতে এখতিয়ারভুক্তভাবে নদী দখলদারদের উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়ে লিখিত চিঠি দেওয়া শুরু করেন। যা তিনি করতে পারেন না। কারণ, নদী কমিশনের চেয়ারম্যান বা কর্মকর্তারা নদীসংশ্লিষ্ট দপ্তর তথা মন্ত্রণালয়কে উচ্ছেদের যৌক্তিকতা তুলে ধরে সুপারিশ করতে পারেন কিন্তু নির্দেশ নয়। এটি সরাসরি নিয়োগ বিধির লঙ্ঘন।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘সাবেক চেয়ারম্যানের এসব অভিযোগ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। দখলদারদের তালিকা তৈরির প্রক্রিয়ার সঙ্গে তিনি (মুজিবর রহমান হাওলাদার) জড়িত ছিলেন না। তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর আমি চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় ঐ তালিকা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু তালিকাটিতে বেশ কিছু ভুলত্রুটি ধরা পড়ায় আমরা তা সংশোধন করছি। কোনোভাবেই তা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।’নিজের আত্মীয়স্বজনের নাম দখলদারদের তালিকায় থাকা নিয়ে মনজুর আহমেদ বলেন, ‘আমি জমিদার পরিবারের সদস্য। পারিবারিকভাবে আমাদের অনেক জমিজমা আছে। এর মধ্যে অনেক জমি নদীর কাছাকাছি। কিন্তু সেগুলোতে তো আমরা কোনো স্থাপনা করিনি। আর দখলদারদের যে তালিকা হয়েছে, তা পানি আইন অনুসারে করা হয়েছে। সেখানে নদীর তীরভূমি কোনটা এবং সেটার সীমানা কী, তা নিয়ে কিছু বলা নেই। ফলে জমির সিএস, আরএস এবং জোয়ারের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা আছে। তা ঠিক করার কাজ আমরা করছি।’