বৈশাখী খরতাপে পুড়ছে প্রায় পুরোদেশ। মধ্যগগণের তাতানো সূর্য যেন তরল গরল ঢালছে চরাচরে। শরীর সেদ্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। কাঠফাটা রোদে দুঃসহ হয়ে উঠেছে জনজীবন। পবিত্র রমজানে রোজা রেখে খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে নেমে এসেছে রীতিমত বিপর্যয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে অসহনীয় গরমের তীব্রতা। হাসঁফাসঁ করছে প্রাণ। প্রচন্ড রোদে,তীব্র তাপদাহে প্রাণিকুলের ত্রাহি দশা। দেশের পশ্চিমে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। টানা ১৪দিন ধরে চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ও খরা বিরাজ করছে। গতকাল রবিবার যশোর ও চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ প্রায় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। আর ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় দ্বিতীয় দিনের মতো ৫৮ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে উষ্ণতা।
বৈশাখের শুরুতে বৃষ্টিহীন এই সময়ে তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। সারাদেশের মানুষ চাতক পাখির মতো বৃষ্টির অপেক্ষায়। তবে আবহাওয়াবিদ ও আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, ঈদের আগে তীব্র খরতাপ থেকে নিস্তার নেই। সহসা বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা না থাকায় দেশে প্রচন্ড গরম থেকে তাৎক্ষণিক স্বস্তির কোনো সম্ভাবনা নেই। সামনের ক’দিনে সর্বকালের রেকর্ড ভাঙা তাপদাহের আশংকা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড করেছে। বর্তমানে বাড়ছে বাতাসে আর্দ্রতা। সেই সঙ্গে বাড়ছে গরমের কষ্ট। ঠোট শুকিয়ে ও ফেটে যাচ্ছে। এবারের গরমে ভিন্নমাত্রা রয়েছে। এবার বাতাসে আর্দ্রতা স্বাভাবিকের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম। সকালে সূর্য ওঠার সাথে সাথে গা জ্বালা পোড়া করে তীব্র রোদে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে এ রোদ যেন আগুনের ফুলকি হয়ে ঝরছে। দুপুরে তরল আগুন হয়ে উঠছে রোদ। বইছে লু হাওয়া।
গতকাল পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দীন জানিয়েছেন,‘তাপমাত্রাজনিত জরুরি অবস্থা’ জারি করা হতে পারে। তিনি বলেন, তীব্র গরমে জনজীবনে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। আমরা চিন্তাভাবনা করছি, জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা যায় কি না। গত দুই দিন শুক্র ও শনিবার অফিস-আদালতে ছুটি ছিল। আজ সোমবার পর্যন্ত অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হবে। তাপমাত্রা যদি এরপরও বাড়তে থাকে,তবে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এদিকে দেশের ১১ টি জেলায় তীব্র তাপদাহ বিরাজ করছে। রেলের গতি ১০০ থেকে কমিয়ে ৭০ কিলোমিটার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কানাডার সাসকোচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ সব আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল পর্যবেক্ষণ করে জানান, ২২ এপ্রিল সম্ভাব্য ঈদের দিন অবধি রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের সকল জেলায় প্রতিদিন ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ওঠার শঙ্কার কথা নির্দেশ করছে আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেলগুলো। আগামী ১৯ ও ২০ এপ্রিল খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের অনেক জেলায় দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠতে পারে। ২১ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকায় প্রতিদিন ৩৯ থেকে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা বজায় থাকার আশংকা রয়েছে। ১৮ থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, কুস্টিয়া, চূয়াডাঙ্গা ও যশোরে ৪১ থেকে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা থাকার আশংকা রয়েছে। ২৩ এপ্রিলের পর কোন জেলায় ৪০ ডিগ্রির ওপর তাপমাত্রা না ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। এই আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ জানান, আগামী ২১ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের ১০ জেলার তাপমাত্রা আরও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। এ সময় মেহেরপুর, যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, পাবনা, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়ায় দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠার কথা নির্দেশ করেছে সকল আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল। ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের পশ্চিমাঞ্চলের কোথাও কোথাও তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে ৪২-৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে যেতে পারে।
আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান বলেন, আসলে ঢাকা কিংবা বড় বড় শহরে তাপমাত্রা যেটি রেকর্ড করা হয় তার চেয়েও বেশি তাপমাত্রা অনুভূত হয়। এর কারণ নগরায়ণ, গাছপালা কমে যাওয়া, মানুষজন এবং যানবাহন বৃদ্ধি। তাপ শোষিত হওয়ার উপায় নেই। ফলে গরম যা রেকর্ড করা হচ্ছে তার চেয়েও তাপ বেশি অনুভূত হচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন বলেন, বছরের এ সময়ে সাগর থেকে হালকা মেঘ আসে। তবে এবার সেই মেঘও আসছে না। ফলে তাপমাত্রা বাড়ছে। এ কারণে এবার তাপপ্রবাহের সময়টা দীর্ঘ হচ্ছে। ২০ এপ্রিল পর্যন্ত এমন পরিস্থিতি থাকতে পারে, এর পর তাপমাত্রা হয়তো কিছুটা কমে আসতে পারে। আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক বলেন, এপ্রিলে তাপমাত্রা বাড়ার প্রবণতা থাকেই। গেল কয়েক বছরেও তাপপ্রবাহ বিরাজ করেছে। এ সময়ে দখিনা বাতাস নেই, বাতাসে আর্দ্রতা কম, মানে জলীয় বাষ্পও তেমন নেই। এ কারণে তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ছে এবং গরমও বেশ অসহনীয় হচ্ছে।
আবহাওয়াবিষয়ক বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ’ওয়েদার অবজারভেশন টিমের’ পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, আগামী কয়েক দিন ঢাকাসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকার তাপমাত্রা আরও কিছুটা বাড়তে পারে। সেই সঙ্গে বাতাসে আর্দ্রতা বাড়বে। ফলে গরমের কষ্ট বাড়তে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তারা জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হওয়ার এবং ইফতারের পর ও সাহরীতে পর্যাপ্ত পানীয় পানের পরামর্শ দিয়েছেন। আবহাওয়া পূর্বাভাসবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ’আক্কু ওয়েদারের’ হিসাবে, গতকাল বেলা আড়াইটায় ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে গরমের তীব্রতা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো অনুভূত হয়েছে। সেই সঙ্গে আর্দ্রতার পরিমাণও ছিল কম, মাত্র ১৮ শতাংশ। এতে তীব্র গরম ও শুষ্ক বাতাস মিলেমিশে জনজীবন অস্থির হয়ে ওঠে। ১৯৬৫ সালে ঢাকার তাপমাত্রা সর্বোচ্চ উঠেছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তারপর গত দুই দিন সর্বোচ্চ গরম পড়েছে।
এদিকে ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের হাওরের নিচু এলাকার সকল ধান ২৫ এপ্রিলের মধ্যে কেটে ফেলার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ। তিনি বলেন, ওই সময়ে পাহাড়ি ঢল, কালবৈশাখী ঝড়, তীব্র বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টির প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। এ সময়ের আগে ধান না কাটলে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।