রাজধানীতে পর পর কয়েকটি মার্কেটে আগুন লাগার পর ব্যবসায়ীরা নিরাপত্তাব্যবস্থা নিতে নতুন নতুন কমিটি করছেন। বাড়াচ্ছেন ফায়ার ফাইটারসহ নিরাপত্তাকর্মীর সংখ্যা। আগুন নেভানোর যন্ত্রপাতি সচল এবং সেগুলো রিফিল করাসহ সব ঠিকঠাক আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকেও ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিটি মার্কেটে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনসহ গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সরেজমিন মার্কেট ঘুরে এবং পুলিশ ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে গতকাল ফায়ার সার্ভিস হালনাগাদ তথ্য হিসেবে ঢাকা অঞ্চলের ৫৮টি মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছে। এই তালিকায় রাজধানী ঢাকায় ৯টি মার্কেট অতিঝুঁকিপূর্ণ, ১৪টি মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ ও ৩৫টি ঝুঁকিপূর্ণ।অতিঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের তালিকায় নাম রয়েছে রাজধানীর টিকাটুলীর রাজধানী সুপারমার্কেটের। মার্কেটটিতে সাড়ে ৭০০ দোকান রয়েছে। বেশির ভাগ দোকানই সেমিপাকা। গতকাল মার্কেটটিতে গিয়ে দেখা গেছে, ঈদে বিক্রির জন্য প্রচুর জামাকাপড়সহ নানা ধরনের জিনিসপত্র উঠিয়েছেন দোকানিরা। প্রতিবছর ঈদের আগে মার্কেটটিতে প্রচুর লোকসমাগম ঘটে; কিন্তু গতকাল দুপুরে গিয়ে তেমন ক্রেতা দেখা যায়নি। দোকানিরা জানান, বিভিন্ন মার্কেটে আগুনের ঘটনা এবং গরমের কারণে ক্রেতা কম। সন্ধ্যার পর মার্কেট জমবে বলে আশা করছেন তাঁরা।
যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে ছেলে মাসুম ও মেয়ে লতিফাকে নিয়ে তাদের জন্য জামা কিনতে এসেছিলেন সেলিনা বেগম। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেভাবে আগুন লাগতাছে মার্কেটে, ভয়ে আছি। দুপুর বেলা আইছি, তাড়াতাড়ি মার্কেট কইরা বাইর হইয়া যামু।’ ব্যবসায়ীরা জানান, তাঁরাও রয়েছেন আতঙ্কে। তাসনিম ফ্যাশন নামের একটি দোকানের মালিক ও ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘আতঙ্কে রয়েছি। তবে আগুন যাতে লাগতে না পারে, সে জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মার্কেটের ভেতরে সিগারেট টানা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাতে পাহারা দেওয়ার জন্য ১২ জনের কমিটি করা হয়েছে। তারা রাত ৩টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করছে। মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড মোকাবেলায় আড়াই লাখ লিটার পানির রিজার্ভ করা হয়েছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর প্রতিটি মার্কেটে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। দোকানিরা নষ্ট ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরাগুলো মেরামত করছেন। যাঁদের নেই তাঁরা নতুন করে ক্যামেরা লাগাচ্ছেন। আগুন নেভানোর যন্ত্রগুলো (ফায়ার এক্সটিগুইশার) ঠিক রয়েছে কি না, তা-ও পরীক্ষা করা হচ্ছে।
পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার জাফর হোসেন গতকাল রাতে বলেন, প্রতিটি মার্কেটে ভোররাতে উর্দি পোশাকের পাশাপাশি সিভিল ড্রেসে পুলিশ মোতায়েন করা হচ্ছে। ব্যবসায়ী সমিতির নেতাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। মশার কয়েল ব্যবহার না করা, বিড়ি-সিগারেট যাতে না খাওয়া হয় সে জন্য সচেতন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের পর ব্যবসায়ীদের সচেতন হতে দেখা যাচ্ছে। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা সচল রাখা ও ভিডিও ফুটেজ সংরক্ষণে রাখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা সেগুলো পালন করছেন।ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের মধ্যে পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারের দুকু টাওয়ারও রয়েছে। এই মার্কেটের ম্যানেজার মো. ইমান আলী গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, দুকু টাওয়ারটি আটতলা। ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে আটতলা পর্যন্ত জুতার গুদাম। নিচতলায় বীজের মার্কেট। মার্কেটে আগুন নেভানোর সব ধরনের সরঞ্জাম রয়েছে। প্রতি তলায় আগুন নেভানোর যন্ত্রপাতি আছে। আগুন নেভানোর প্রশিক্ষণও রয়েছে মার্কেটের কর্মীদের।
এদিকে গতকাল দুপুরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরে ‘অগ্নিনিরাপত্তা ও ঝুঁকি’ নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘নিউ সুপার মার্কেটসহ রাজধানীতে ৯টি অতিঝুঁকিপূর্ণ, ১৪টি মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৩৫টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে। গত দুই সপ্তাহে ৫৮টি ভবন হালনাগাদ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবছর আমরা এই হালনাগাদ করি। এরপর সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে ভবন মালিককে জানাই। চিহ্নিত সমস্যাগুলো সমাধান না করলে আমরা ব্যানার টানিয়ে দিই, যেন জনগণ সচেতন হয়।’ তিনি জানান, ২০১৮ সালে এক হাজার ৫১১টি ভবন, মার্কেট, রেস্টুরেন্টের তথ্য হালনাগাদ করা হয়েছিল।
সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডগুলো নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে আগুন নেভাতে পারছি না। ভবনগুলোতে মহড়া না করার কারণে আমাদের যেসব যন্ত্রপাতি রয়েছে সেগুলো ব্যবহার করতে পারছি না।’ তিনি সবাইকে বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি সংরক্ষণ ও মহড়ার আয়োজন করার অনুরোধ জানান। পাশাপাশি মার্কেটের প্রতিটি স্থানে পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করার আহ্বান জানান। অতিরিক্ত দাবদাহের কারণে বস্তুর দাহ্য হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি বলে জানান তিনি।তাজুল ইসলাম বলেন, দোকানে, করিডরে, সিঁড়িতে ও দোকানের সামনে মালপত্র স্তূপ করে রাখা যাবে না। মার্কেটের ভেতরে কোনো ধরনের ধূমপান করা যাবে না। অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের শুরুতেই ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিতে হবে। ফায়ার সার্ভিসকে নির্বিঘ্নে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। আগুন নেভানোর সময় মার্কেটের মালপত্র টানাহেঁচড়া করা যাবে না।
অতিঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট :
ফায়ার সার্ভিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে ৯টি অতিঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটগুলো হলো নিউ মার্কেট রোডের গাউসিয়া মার্কেট, গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়ার বরিশাল প্লাজা, রাজধানী ও নিউ রাজধানী সুপার মার্কেট, চকবাজারের আলাউদ্দিন মার্কেট, শাকিল আনোয়ার টাওয়ার, শহিদুল্লাহ মার্কেট, সদরঘাটের শরীফ মার্কেট, মায়া কাটারা (২২ মার্কেট) ও সিদ্দিকবাজারের রোজনীল ভিস্তা।
মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ :
জুরাইনের আলম সুপারমার্কেট, খিলগাঁওয়ের উত্তরা মার্কেট, ডেমরার সালেহা শপিং কমপ্লেক্স, মনু মোল্লা শপিং কমপ্লেক্স, দোহারের জয়পাড়ার লন্ডন প্লাজা শপিং মল, ওয়ারীর র্যাংকিন স্ট্রিটের এ কে ফেমাস টাওয়ার, রোজভ্যালি শপিং মল, নিউ মার্কেটের মেহের প্লাজা, মিরপুর রোডের প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টার, নিউ চিশতিয়া মার্কেট, নেহার ভবন, এলিফ্যান্ট রোডের ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং কমপ্লেক্স, ইসমাইল ম্যানশন সুপারমার্কেট, সুবাস্তু অ্যারোমা শপিং মল।
ঝুঁকিপূর্ণ :
এই তালিকায় রয়েছে জুরাইনের বুড়িগঙ্গা সেতু মার্কেট, খিলগাঁওয়ের তালতলা সিটি করপোরেশন সুপারমার্কেট, খিলগাঁও সিটি করপোরেশন কাঁচাবাজার মার্কেট, তিলপাপাড়া মিনার মসজিদ মার্কেট, ডেমরার হাজী হোসেন প্লাজা, ইসলাম প্লাজা, ডেমরার নিউ মার্কেট, দোহারের আয়েশা শপিং কমপ্লেক্স, এ হাকিম কমপ্লেক্স, ঢাকার নবাবগঞ্জের শরীফ কমপ্লেক্স, মিরপুরের বাচ্চু মিয়া কমপ্লেক্স, কাফরুলের ড্রিমওয়্যার, মিরপুর-১-এর এশিয়ান শপিং কমপ্লেক্স, মুক্তিযোদ্ধা সুপারমার্কেট, ফেয়ার প্লাজা, তেজগাঁও শিল্প এলাকার শেপাল এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেড, নাসা মেইনল্যান্ড, জাকারিয়া ম্যানশন, লালবাগের হাজী আব্দুল মালেক ম্যানশন, ওয়ারীর ইপিলিয়ন হোল্ডিং লিমিটেড, মিরপুর রোডের গ্লোব শপিং সেন্টার, মিরপুর রোডের চন্দ্রিমা সুপারমার্কেট, চাঁদনীচক মার্কেট, নিউ সুপার মার্কেট, নূরজাহান সুপারমার্কেট, হযরত বাবুশাহ হকার্স মার্কেট, নীলক্ষেতের ইসলামিয়া বই মার্কেট, গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া সুপারমার্কেট-১, সিদ্দিকবাজারের হান্নান ম্যানশন, সিটি প্লাজা ফুলবাড়িয়া সুপারমার্কেট-২, গুলিস্তানের নগর প্লাজা, সিদ্দিকবাজারের রোজ মেরিনার্স মার্কেট ও সিদ্দিকবাজারের দুকু টাওয়ার।