দনাসহ প্রতিবছর কোনো একটি পণ্যকে বর্ষপণ্য ঘোষণা করে। চলতি বছরের বর্ষপণ্য হলো পাট ও পাটজাত পণ্য। কিন্তু সদ্যোবিদায়ি অর্থবছরে (২০২২-২৩) এই বর্ষপণ্যের বেহাল অবস্থা। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সরকার বর্ষপণ্য ঘোষণা করলে ওই পণ্যে উদ্যোক্তারা কোনো সুনির্দিষ্ট সুবিধা না পেলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নীতি সুবিধা ও কর্মপরিকল্পনায় অগ্রাধিকার দেয়।
যদিও বহুমুখী পাটপণ্যে সরকার ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দিয়েছে।এদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সদ্যোবিদায়ি ২০২২-২৩ অর্থবছরের পাট ও পাটজাত পণ্যে রপ্তানি আয়ে ১৯ শতাংশের বেশি ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ সময় রপ্তানি আয় হয়েছে ৯১.২২ কোটি ডলার। এর আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) আয় ছিল ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার।
এ ছাড়া লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কম হয়েছে প্রায় ২৯ শতাংশ। আর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২৮ কোটি ডলার। এ সময় কাঁচা পাট রপ্তানি থেকে আয় এসেছে ২০ কোটি ৪১ লাখ ডলার। পাটের সুতা থেকে আয় হয়েছে ৪৯ কোটি ৭৯ লাখ ডলার এবং পাটের বস্তা (জুট স্যাকস অ্যান্ড ব্যাগ) থেকে আয় হয়েছে ১০ কোটি ৯৮ লাখ ডলার।কাঁচা পাটে আগের বছরের চেয়ে আয় কমেছে ৫.৫৬ শতাংশ; পাটের সুতায় আয় কমেছে ২৮.৬৪ শতাংশ এবং পাটের বস্তা থেকে আয় কম হয়েছে ৭.৮৮ শতাংশ। তবে ব্যতিক্রম হচ্ছে পাটের অন্যান্য পণ্য থেকে আয় হয়েছে ১০ কোটি ডলার। এতে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬.২৩ শতাংশ।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বিশ্ববাজারে মন্দা হলেও অভ্যন্তরীণ বাজারে দুই বছর ধরে পাটের দর বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ, যা ২০২০ সালে প্রতি মণ (৪০ কেজি) কাঁচা পাটের দর ছিল তিন হাজার টাকা। বর্তমানে সেই একই পাট বিক্রি হচ্ছে ছয় হাজার টাকা।এ ছাড়া পাটের সুতার বড় বাজার ছিল তুরস্ক ও ইরান। পাটের সুতা আমদানি করে দেশগুলো কার্পেট তৈরি করত। তারা এক বছর ধরে পোশাকের ওয়েস্ট থেকে তৈরি সুতা বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করছে। এ ছাড়া পাটের সুতার দাম বেড়েছে ৬৫ শতাংশের বেশি। এর পাশাপাশি ইউরোপে মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তা পর্যায়ে বহুমুখী পাটের পণ্য কেনার প্রবণতা কমেছে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। ২০২৩ সালের পুরোটা খারাপ অবস্থা যাবে এই খাতের।
এমন অবস্থা থেকে উত্তোরণে কাঁচা পাট রপ্তানি না বাড়িয়ে পণ্য বহুমুখীকরণ ও উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলেছেন উদ্যোক্তারা। এ ছাড়া গবেষণা ও কাস্টমস বন্ড সুবিধা এবং ব্র্যান্ডিং ও বিপণনে কার্যকর কর্মসূচি নেওয়ার জন্য প্রয়োজন বড় বিনিয়োগ। এই বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মতো স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের কর অবকাশ সুবিধাসহ সরকারের দীর্ঘমেয়াদি নীতি সহায়তার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন তাঁরা।
এ প্রসঙ্গে বহুমুখী পাটপণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বিডি ক্রিয়েশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল করিম মুন্না বলেন, ‘বিশ্ববাজারে বহুমুখী পাটপণ্যের বিশাল সম্ভাবনা থাকলেও বৈশ্বিক মন্দায় সদ্যোবিদায়ি অর্থবছরে রপ্তানিতে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের প্রধান বাজার ইউরোপে ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ভোক্তা পর্যায়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। পাটজাত পণ্য অপরিহার্য নয় বলে খরচ কমিয়েছেন ভোক্তারা।’
এ খাতের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে রাশেদুল করিম মুন্না আরো বলেন, ‘বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে দেশে ৫০ বছরের পুরনো পাটকলগুলোকে আধুনিকায়ন করতে হবে। এই মুহূর্তে বিশ্ববাজারে সবুজ পণ্যের বিপুল চাহিদা রয়েছে। বিশ্বের ৬০টি দেশ প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছে। এখানেও বাংলাদেশের বিপুল সুযোগ রয়েছে। কেননা বাংলাদেশের কাঁচা পাট নিয়ে ভারত বিশ্ববাজারের বেশির ভাগ দখল করে আছে; সেখানে বাংলাদেশের হিস্যা নেই বললেই চলে।’এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সরকারের পাটপণ্য বহুমুখীকরণের প্রতিষ্ঠান জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারের (জেডিপিসি) সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পাট ও পাটজাত পণ্য কোনো অপরিহার্য পণ্য নয়। এর পরও দেশের বহুমুখী পাটজাত পণ্যের প্রধান বাজার ইউরোপ। এ বাজারে মূল্যস্ফীতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এমন নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।’
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুসারে, গত পাঁচ বছরে পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে রপ্তানি আয়ের মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছে ৮১ কোটি ৬২ লাখ ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১১৬ কোটি ১৪ লাখ ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার এবং সদ্যোবিদায়ি অর্থবছরে (২০২২-২৩) আয় হয়েছে ৯১ কোটি ২২ লাখ ডলার। গত পাঁচ বছরে পাট ও পাটজাত পণ্যে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বাংলাদেশের জিডিপিতে পাটশিল্পের অবদান ১ শতাংশ হলেও সামগ্রিক রপ্তানি আয়ে এর অবদান ৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ পাট থেকে ২৮৫টি পণ্য উৎপাদন করে বিশ্ববাজারে রপ্তানি করে। প্রধান পণ্যের মধ্যে রয়েছে কাঁচা পাট, পাটের হেসিয়ান, ব্যাগ, বস্তা, দড়ি, পাটের সুতা, কার্পেট, ক্যাপ, ম্যাট, কার্পেট ব্যাকিং কাপড়, প্যাকিং সামগ্রী, মোড়ানো কাপড়, ফলের ঝুড়ি, কলমের কেস, মানিব্যাগ, পর্দা, চেয়ার, কভার, পাটের শিট, পাটের সুতার বর্জ্য, তারপলিন, ক্যানভাস, হাইড্রোকার্বনমুক্ত পাটের কাপড়, জিওটেক্সটাইল, সজ্জা ও কাগজ, গৃহস্থালি পণ্য এবং হাতে বোনা বস্ত্র ইত্যাদি।
আন্তর্জাতিক জুট স্টাডির তথ্য মতে, বিশ্ববাজারে ৫০০ বিলিয়ন ৫০ হাজার কোটি পিস পাট ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। দ্য বিজনেস রিসার্চ কম্পানির তথ্য অনুসারে, পরিবেশবান্ধব পাট ও পাটজাত পণ্যের বিশ্ববাজার বাড়ছে। ভোক্তার আগ্রহে ব্যাপক পরিবর্তন আসায় বিশেষ করে পাটের ব্যাগের চাহিদা বাড়ছে বেশি।