গতকাল মঙ্গলবার ইসরায়েলে প্রায় ২০০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান। আকস্মিক এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার একেবারে চরমে পৌঁছেছে। এরই মধ্যে ইসরায়েল চরম প্রতিশোধের অঙ্গীকার করেছে। তবে এই দুই দেশের সম্পর্ক সবসময় এমন খারাপ ছিল না। অবিশ্বাস্য মনে হলেও, একসময় ইসরায়েল ও ইরান এক হয়ে একে অপরকে সহযোগিতার মাধ্যমে একই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।
১৯৬০-এর দশকে ইসরায়েল ও ইরান উভয়ই ইরাককে পারস্পরিক প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়েছিল। যখন ইসরায়েল শত্রুভাবাপন্ন আরব শাসকদের বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তর সংগ্রাম করছিল। আর তখন শাহ’র অধীনে ইরান ইরাকের নেতৃত্বকে নিজেদের নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক আধিপত্যের জন্য সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখছিল।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গোপন অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ইরান-ইসরায়েল ইরাকের বিরুদ্ধে এক হয়। যেখানে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এবং ইরানের গোপন বাহিনী সাভাক উভয়েই কুর্দি বিদ্রোহীদের কেন্দ্রীয় ইরাকি শাসনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই কুর্দি গোষ্ঠীগুলো ইরাকের আরব জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের ‘অ্যাচিলি’স হিল’ হিসেবে দেখা হতো, যা ইরাকি সরকারকে ভেতর থেকে দুর্বল করতে ভূমিকা রাখে।
ইসরায়েল ও ইরানের সহযোগিতা নতুন উচ্চতায় পৌঁছায় যখন ১৯৫৮ সালে তুরস্কসহ একটি ত্রিদলীয় গোয়েন্দা জোট ‘ট্রাইডেন্ট’ গঠন করা হয়। এই জোটের মাধ্যমে এই তিনটি অ-আরব শক্তি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় ও যৌথ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে। সম্পর্কের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে, ইসরায়েল ও ইরান একে অপরের আরো ঘনিষ্ঠ হয়, যা শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসনামল পর্যন্ত গভীর সামরিক এবং গোয়েন্দা সম্পর্ক গড়ে তোলে।
শাহ কেবল কৌশলগত স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত ছিলেন না বরং তিনি ইসরায়েলের যুক্তরাষ্ট্রে প্রভাব সম্পর্কে অবগত ছিলেন। ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নত করার সম্ভাব্য একটি মাধ্যম হিসেবে দেখেছিলেন, বিশেষ করে যখন কেনেডি প্রশাসন তাঁর স্বৈরাচারী শাসন সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।
ইসরায়েল-ইরান সম্পর্ক ইরানের পশ্চিমের সাথে সংযুক্ত হওয়ার কৌশলের একটি প্রধান দিক হয়ে ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ষাটের দশকের মাঝামাঝি তেহরানে একটি স্থায়ী ইসরায়েলি প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা কার্যত একটি দূতাবাস হিসেবে কাজ করত।
তবে দুই দেশের সম্পর্ক জটিলতাবিহীন ছিল না। শাহ আরব বিশ্বের মধ্যে ব্যাপক ইসরায়েলবিরোধী অনুভূতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তাই তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে জনসমক্ষে সতর্কতা অবলম্বন করতেন। ১৯৬৭ সালের ছয়দিনের যুদ্ধের পর তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরো সমালোচক হয়ে ওঠেন। তবে কৌশলগত স্বার্থ তাঁর আদর্শগত বা কূটনৈতিক অবস্থানের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লব ইরানের রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে নাটকীয়ভাবে বদলে দেয়। দেশটিকে একটি ইসরায়েলবিরোধী ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পরিণত করে। তবুও আয়াতুল্লাহ খোমেনির ক্ষমতালাভের পর নতুন সরকারও গোপনে ইসরায়েলের সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রাখে। ১৯৮০-১৯৮৮ সালের ইরাক-ইরান যুদ্ধে উভয় দেশ সাদ্দাম হোসেনের ইরাকের বিরুদ্ধে একত্রে কাজ করে।
ইসরায়েলও ইরানকে সহায়তা করার সুযোগটি দেখেছিল। বিশেষ করে ইরাককে আরো তাৎক্ষণিক এবং বিপজ্জনক হুমকি হিসেবে দেখা হতো। কারণ, বাগদাদের আঞ্চলিক আধিপত্যের আকাঙ্ক্ষা এবং পারমাণবিক ক্ষমতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বারা সমর্থিত ইরাকের শক্তিশালী সেনাবাহিনী একটি অন্যতম ঝুঁকি ছিল। ইসরায়েল যখন ১৯৮০ সালে প্রধানমন্ত্রী মেনাহেম বেগিন সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির অনুমোদন দেয়, তখন ইরাকে অস্ত্র পাঠানো একটি সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত ছিল যাতে ইরাকের শক্তিকে দুর্বল করা যায়।
এই গোপন অস্ত্র চুক্তিগুলো সেই মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল যা তেহরানে বন্দী আমেরিকানদের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত ইরানের জন্য সামরিক সহায়তা নিষিদ্ধ করেছিল। ইসরায়েলের সামরিক সহায়তার বিনিময়ে, খোমেনি সরকারের অধীনে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইরানি ইহুদীকে ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, যা সম্পর্কের বাস্তবিক প্রকৃতিকে তুলে ধরে।
বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইরান-ইসরায়েল সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে অবনতি ঘটে। হিজবুল্লাহ এবং হামাসের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রতি ইরানের সমর্থন ইসরায়েলের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে অবস্থানকে সুদৃঢ় করে। রমজান আহমেদিনেজাদের শাসনামলে দুই দেশের মধ্যে দূরত্বকে আরো বাড়িয়ে দেয়।
আর এই ২০২৪ সালে এসে উত্তেজনা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইসরায়েল হামাস, হিজবুল্লাহ ও হুথিদের বিরুদ্ধে বহুমুখী সংঘর্ষে জড়িয়েছে। যাদের সবাই ইসরায়েল প্রশ্নে ইরানের ‘প্রতিরোধ অক্ষের’ অংশ। এই ভূরাজনৈতিক পরিবেশ অতীতে তাদের সহযোগিতা এবং বর্তমান বাস্তবতার মধ্যে বিপরীতমুখী অবস্থানকে তুলে ধরে। কারণ, দুই দেশ চরম শত্রুতা এবং আঞ্চলিক শক্তির লড়াইয়ে জড়িয়েছে। বর্তমানে সর্বাত্মক যুদ্ধে ধাবিত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে ইরান-ইসরায়েল।