জানা গিয়েছে, সিলেট নগরীর ‘ঘাসিটুলা’ এলাকা বেত শিল্পের জন্য বিখ্যাত। এখানে ‘বেতের বাজার’ নামে একটি বাজারও রয়েছে। একটা সময় এ ঘাসিটুলায় বেত শিল্প কেন্দ্র গড়ে তোলা হলেও কিছুদিন পরে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া বর্তমানে সিলেটে হাতেগোনা কয়েকটি বেতের আসবাব ও ফার্নিচারের দোকান রয়েছে। শাহজালাল মাজার গেট, জিন্দাবাজার, ওসমানী মেডিকেলের পাশে নবাব রোডে রয়েছে এসব বেতের আসবাবপত্রের দোকান। যেখানে বেতের তৈরি ম্যাগাজিন র্যাক, টেলিফোন চেয়ার, সোফাসেট, বেড সেট, স্যুজ র্যাক, ট্রলি, টেবিল, চেয়ার, ফোল্ডিং চেয়ার, কর্নার সোফা, ইজি চেয়ার, ডায়নিং চেয়ার, বেবি কট ও নবাব সেটসহ রকমারি ফার্নিচার বিক্রি এবং প্রদর্শন করা হয়।
হারিয়ে যাচ্ছে সিলেটের বেতশিল্প। অথচ বেতের তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা ব্যাপক। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও রফতানি হয়। সে শিল্প এখন ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। কারিগররা পেশা বদল করেছেন। যারা কোনো রকমে টিকে আছেন তারা বলছেন, প্লাস্টিক পণ্যের ভিড়ে এখনো রয়েছে বেতের তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা। এ শিল্পকে বাঁচাতে প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতা। সরকার চাইলে এ বেত শিল্পকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব।
অন্যদিকে কয়েকটি দোকানে বেতের তৈরি জিনিসপত্র থাকলেও নেই আগের মতো কারিগরের উপস্থিতি। আবার কারিগরের অনেকেই বেতের আসবাবপত্র তৈরির কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় জড়িয়েছেন। প্লাস্টিক পণ্যের ভিড়ে বতর্মানে শৈল্পিক কারুকাজ ও দৃষ্টিনন্দন নিপুণ হাতে বেতের আসবাবপত্র ও ফার্নিচারের জনপ্রিয়তা বাড়লেও উৎপাদন বাড়ছে না। তবু কিছু ব্যবসায়ী ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ শিল্পের প্রসারে ভূমিকা রাখছেন।
ঘাসিটুলার ‘মেসার্স কেইন ফার্নিচার’-এর মালিক এসএম ফয়জুল হক দুলু জানান, মেশিনের তৈরি প্লাস্টিক সামগ্রী এবং কাঠের তৈরি বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের ভিড়ে পিছিয়ে পড়েছে বেত শিল্প। টিলা বনাঞ্চল কমে যাওয়ায় আগের মতো চাহিদা অনুযায়ী বেতও পাওয়া যায় না। দূর-দূরান্তে কিছু কিছু স্থানে ছোট আকৃতির বেত পাওয়া গেলেও যাতায়াত ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ শেষে কিছুই থাকে না। পথে পথে পুলিশ এবং বন কর্মকর্তাদের হয়রানি তো আছেই। অন্যদিকে মোটা আকৃতির বেত, যেগুলোকে ‘গল্লাবেত’ বলা হয়; সেগুলো এখন স্থানীয়ভাবে খুব উৎপাদন কম হয়। ফলে ব্যবসা ধরে রাখতে এবং ক্রেতাদের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে সেই মোটা বেত মিয়ানমার ও ইন্দোনেশিয়া থেকে সংগ্রহ করতে হয়।
‘ইয়াসিন কেইন ফেয়ার’-এর স্বত্বাধিকারী আশরাফুল ইসলাম আশরাফ জানান, একসময় তাদের ব্যবসা সিলেটের সীমানা ছাড়িয়ে ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় কাজের চাপ বেশি থাকায় ঠিকমতো খাবারের সময়টাও মিলত না। এখন সেই সুদিন নেই।
নবাব রোডের ‘এবি কেইন’-এর কর্ণধার আরিফুল ইসলাম জানান, লন্ডন-আমেরিকাসহ কয়েকটি দেশে বেতের তৈরি আসবাব রফতানি করতেন তিনি। পরবর্তী সময়ে সেই সম্ভাবনার পথ বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বলেন, নানা বাস্তবতায় বেত শিল্প বিলুপ্তির পথে এসে দাঁড়িয়েছে। এজন্য তিনি মেশিনের তৈরি কাঁচ এবং প্লাস্টিকের তৈরি অভিজাত ফার্নিচারের সহজলভ্যতাকে দায়ী করেন।
আরিফুল ইসলাম আরো বলেন, স্থানীয়ভাবে বেত উৎপাদন কমে গিয়েছে। আগে যেসব বনজঙ্গল কিংবা টিলা এলাকায় বেত প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠত সেই পরিবেশ এখন নেই। তার পরও যেসব এলাকা থেকে কিছু বেত সংগ্রহ করা হতো, সেই পথও বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। এখন বিদেশ থেকে বেত আমদানি করে আমাদের টিকে থাকতে হচ্ছে।
বেত শিল্পের দুর্দিনের মধ্যেও প্রচণ্ড আশাবাদী নিউ সিলেট কেইন ফ্যাক্টরির স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ মাহমুদ আলী। তিনি জানান, ঘাসিটুলা থেকেই দেশ-বিদেশে বেত শিল্পের সুনামের গোড়াপত্তন হয় ঘাসিটুলার বেত শিল্পের সে খ্যাতি আজ আর নেই বললেই চলে। অথচ একসময় পুরো ঘাসিটুলা এলাকার মানুষই বেত শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি বলেন, বর্তমানে বেতই মিলছে না। অনেক বেত আছে, যেগুলো মিয়ানমার ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করতে হয়।
সিলেটের সুশীল সমাজের অন্যতম প্রতিনিধি দেশের প্রাচীনতম সাহিত্য পত্রিকা আল ইসলাহ-এর বর্তমান সম্পাদক কথাশিল্পী সেলিম আউয়াল বলেন, একসময় সিলেটের বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে অফিস-আদালতেও শোভা পেত হাতে তৈরি বেতের আসবাব। টেকসই এবং আরামদায়ক বেতের প্রতিটি পণ্যের সুনাম দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশের বাজারেও ছিল।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক খন্দকার সিপার আহমদ বলেন, বেত একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প। এ শিল্পকে এখনো জাগিয়ে তোলা সম্ভব। সিলেটে পরিকল্পিতভাবে বেত শিল্পের কারখানা তৈরি হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি ব্যাপক কর্মস্থানেরও সৃষ্টি হবে।
সিলেট পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক এমরান হোসেন বলেন, আমরা এ শিল্পকে আবার কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় এজন্য বসব। স্থানীয়ভাবে কীভাবে বেত সংগ্রহ করা যায়, সেই বিষয়টিও দেখব। দিন দিন টিলা ও পাহাড় কমে যাচ্ছে। ফলে সংকটে পড়েছে বেত শিল্প। পরিকল্পিতভাবে বেত চাষের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করব।