রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০২:১৫ অপরাহ্ন

নিট রিজার্ভ অর্জন ও খেলাপি ঋণ কমানোর তাগিদ

প্রতিনিধির / ৭৭ বার
আপডেট : সোমবার, ৮ মে, ২০২৩
নিট রিজার্ভ অর্জন ও খেলাপি ঋণ কমানোর তাগিদ
নিট রিজার্ভ অর্জন ও খেলাপি ঋণ কমানোর তাগিদ

বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ অর্জন ও খেলাপি ঋণ কমানোর বিষয়ে জোর তাগিদ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তাদের ঋণের শর্ত অনুযায়ী জুনের মধ্যে নিট রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাতে প্রয়োজন ৪৫০ কোটি ডলার। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এটা অর্জন ও প্রকাশের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। বর্তমান রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের সর্বশেষ অবস্থা নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকগুলোতে পড়ে থাকা বাংলাদেশিদের তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যাপারেও জানতে চেয়েছে আইএমএফ।

আগামী অর্থবছরে ৬৫ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত রাজস্ব কিভাবে এবং কোন কৌশলে আহরণ করা হবে সে বিষয়েও তাদের প্রশ্ন রয়েছে। তারা বলেছেন, ‘একটি চ্যালেঞ্জিং পটভূমিতে, বাংলাদেশ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি। এ ধরনের নানা প্রশ্ন উত্থাপন, আলোচনা এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকের মধ্য দিয়ে রোববার শেষ হয়েছে আইএমএফের প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফর।

আগামী সেপ্টেম্বরে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের তাগিদ দিয়েছে। এছাড়া আরও কয়েকটি তাগিদের মধ্যে আছে আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য ডলারের মূল্য ‘এক রেট’ এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিনিয়ম হার বাজারভিত্তিক চালু ও রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ। এ ছাড়া সংস্কারসহ ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমানো, সুদ হারে করিডোর ব্যবস্থা চালু ও সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন আগামী সংসদে উত্থাপন।

দু’সপ্তাহ্ব্যাপী ঢাকা সফরকালে সংস্থাটির প্রতিনিধিরা এসব বিষয়ে তাগিদ দেন। রোববার এ সফরের সমাপনী টানা হয়। এ ছাড়া ঋণের শর্ত অনুযায়ী কর বাড়াতে এর ব্যবস্থা সংস্কার ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর রূপরেখা প্রণয়ন করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হ্রাসের কারণ, দেশে বৈদেশিক ঋণের অঙ্ক, কোয়ার্টারভিত্তিক জিডিপির হিসাব চালুর অগ্রগতি প্রসঙ্গ নিয়ে তারা কথা বলেন।এদিকে রোববার এক বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশ মিশনের প্রধান রাহুল আনন্দ বলেছেন, তিনটি চ্যালেঞ্জের মুখে আছে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। এক. ক্রমাগত মুদ্রাস্ফীতির চাপ, দুই. বৈশ্বিক আর্থিক অস্থিরতা এবং তিন. বাণিজ্যের অংশীদারদের মধ্যে মন্দা প্রবৃদ্ধি হ্রাস। যে কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং টাকার ওপর চাপ অব্যাহত আছে।

প্রসঙ্গত, আইএমএফের ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণের প্রথম কিস্তি গত ফেব্রুয়ারিতে পেয়েছে বাংলাদেশ। আগামী নভেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়কে কেন্দ্র করে গত ২৫ এপ্রিল থেকে ৭ মে পর্যন্ত ঢাকা সফর করেছে দলটি। তাদের ঋণে বাস্তবায়ন কর্মসূচি এবং শর্তের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতেই দলটি ঢাকায় আসে। গত ১৪ দিনে তারা অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে ৩৫টি বৈঠক করেছে।

আইএমএফের শর্তে আছে জুনের মধ্যে নিট রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন (২৪৪৬ কোটি) ডলার থাকতে হবে। বর্তমান মোট রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন (৩১১৮ কোটি) ডলার আছে। অর্থ বিভাগের হিসাবে এর মধ্যে নিট রিজার্ভ সম্ভাব্য ২০ বিলিয়ন (২০০০ কোটি) ডলার হবে। ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিট রিজার্ভে পৌঁছাতে ৪৫০ কোটি ডলার প্রয়োজন, যা অনেকটাই অসম্ভব। যদিও এ নিয়ে সংস্থাটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে জানান, জুনের মধ্যে নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে শর্ত পূরণ নাও হতে পারে। তবে শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে সংস্থাটির স্টপ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম থেকে একটি ছাড়পত্র প্রয়োজন হবে। নরমালি ওয়েভার চাইতে গেলে ঋণের সুদ হারের ক্যাপ তুলে দেওয়া, মুদ্রা বিনিয়ম হার বাজারভিত্তিক করার অঙ্গীকার চাইতে পারে সংস্থাটি।

এদিকে ঋণের শর্ত পূরণে পহেলা সেপ্টেম্বর থেকেই নতুন ফর্মুলায় জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় প্রক্রিয়া কার্যকর করা হবে। আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের সঙ্গে মিল রেখে মূল্য সমন্বয় হবে। আইএমএফ প্রতিনিধি দলকে এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। এই প্রক্রিয়া শুরুর পর প্রতি তিন মাস অন্তর জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন ফর্মুলা বাস্তবায়ন হলে বিশ্ববাজারে ঘন ঘন জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব বাজেটে পড়বে না। যেহেতু তেলের ভর্তুকির প্রশ্ন উঠবে না, তাই সে টাকা অন্য কোথাও ব্যয় করা যাবে। বিশ্ববাজারে মূল্য কমার সুবিধাও ক্রেতারা সরাসরি পাবেন এবং দাম বৃদ্ধি পেলে ক্রেতা সাশ্রয়ী হওয়ার সুযোগ পাবেন। বর্তমানে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকায় বেশিতে কিনে কম মূল্যে দেশে বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে বিপিসি লোকসান দিচ্ছে। আর এই লোকসান ভর্তুকি দিয়ে মোকাবিলা করা হচ্ছে।

এদিকে ‘সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনের’ খসড়া আগামী সংসদ অধিবেশনে উত্থাপন করার তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বর্তমান রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের সর্বশেষ অবস্থাও জানতে চেয়েছে। প্রসঙ্গত, বিদায়ি বছরে (২০২২) ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। আগের বছরে (২০২১) ছিল এক লাখ তিন হাজার ২৭৩ হাজার কোটি টাকা।

রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য সম্প্রতি কোনো সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে কিনা এবং আগামীতে সংস্কারের পরিকল্পনা, আইনগুলোর সংশোধন ও বাস্তবায়ন অবস্থা এবং ‘ব্যাসেল স্ট্যান্ডার্ড’ (কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মানদণ্ড) অনুযায়ী খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও জানতে চেয়েছে সংস্থাটি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন. আইএমএফ বলা বা না বলার বিষয় নয়, খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। যেহেতু সংস্থাটি বলেছে এখন আরও শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে এক্ষেত্রে মূল দায়িত্ব ব্যাংকগুলোর। প্রয়োজনে খেলাপি হওয়া যাদের অভ্যাস তাদের নিয়ে ব্যাংকগুলো আলাদা কেইস টু কেইস ভিত্তিতে বসতে পারে।

এদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকগুলোতে পড়ে আছে বাংলাদেশিদের তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই বিপুল অঙ্কের ডলারের ব্যাপারে জানতে চেয়েছে আইএমএফ। এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব তপনকান্তি ঘোষ যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে, তিন বিলিয়নের রপ্তানি বিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংক হিসাবে পড়ে আছে। আমি তাদের (আইএমএফ) বলেছি কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও ভালো বলতে পারবে। তবে হঠাৎ এক বছরের একটি ডলারের ঘাটতি হিসাব দিয়ে প্রকৃত মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। প্রয়োজনে বিগত কয়েক বছরের এ ধরনের ডলার ঘাটতি হয়েছে কিনা সেটি দেখতে হবে।

এদিকে আইএমএফের ঋণের শর্ত অনুযায়ী আগামী অর্থবছরের অতিরিক্ত কর আদায় বাড়াতে হবে মোট জিডিপির শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ। ওই হিসাবে চলতি অর্থবছরের তুলনায় কমপক্ষে ৬৫ হাজার কোটি টাকা বাড়তি আহরণ করতে হবে। এ বিষয়ে আইএমএফ জানতে চেয়েছে কিভাবে এবং কোন কৌশলে এই অতিরিক্ত কর আহরণ করা হবে। এছাড়া চলতি সংশোধিত বাজেট এবং আগামী অর্থবছরের বাজেটে কত টাকা ব্যয় হবে, অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও পরবর্তী উত্তরণে পদক্ষেপগুলো নিয়েও আলোচনা হয়। অপর দিকে মধ্যবর্তী অর্থবছরের (২০২৪-২০২৭) বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনা এবং ঘাটতি অর্থায়নে চার ভাগের এক অংশ সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

শেষ দিনে আইএমএফের বৈঠক : রোববার সফরের শেষ দিনে আইএমএফ প্রতিনিধি দল পৃথক দুটি বৈঠক করেছে। সকালে প্রথম বৈঠক করে অর্থ সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন এবং পরবর্তী বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে। সংস্থাটির প্রতিনিধি দলের সফরে একটি পর্যালোচনা তুলে ধরেন অর্থ সচিবের কাছে। ওই বৈঠকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মূল্যস্ফীতি এবং রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি রিজার্ভ কমে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী মুদ্রানীতিতে বাজারভিত্তিক সুদ হার চালুর ঘোষণা দেবে। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনার আন্তর্জাতিক রীতি অনুসরণ করে নিট রিজার্ভ প্রকাশ করবে। ওই সময় থেকে ডলারের একক বিনিময় হারও চালু করা হবে। আগামী জুলাইয়ে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে। ওই মুদ্রানীতিতে এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। বাংলাদেশ ও আইএমএফের যৌথ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করতে সংস্থার একটি প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফর রোববার শেষ হয়েছে। শেষ দিনে আইএমএফ প্রতিনিধি দলটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছে।

আইএমএফের বিবৃতি : রোববার আইএমএফের ওয়েবসাইডে বাংলাদেশে সংস্থাটির প্র্রতিনিধি দলের সফর প্রসঙ্গে একটি বিবৃতি দিয়েছে। সেখানে বলা হয়, আইএমএফের ঋণে কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করতে মিশন প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে একটি দল ঢাকায় সফর করেছে। সেখানে আইএমএফ বাংলাদেশের মিশন প্রধান রাহুল আনন্দ বলেন, ‘একটি চ্যালেঞ্জিং অর্থনৈতিক পটভূমিতে, বাংলাদেশ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি।

সফরের সময় আমরা সাম্প্রতিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক এবং আর্থিক খাতের উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করেছি। ঋণের শর্ত পূরণে প্রতিশ্রুতির অগ্রগতি পর্যালোচনা করেছি। আইএমএফের ঋণ এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ), রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) ব্যবস্থার প্রথম পর্যালোচনায় এই সফরের প্রাপ্ত তথ্য এ বছরের শেষ দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে মূল্যায়ন করা হবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ