সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০২:৪৪ পূর্বাহ্ন

মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকট অর্থনীতির প্রধান সমস্যা

প্রতিনিধির / ১৬৮ বার
আপডেট : রবিবার, ১১ জুন, ২০২৩
মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকট অর্থনীতির প্রধান সমস্যা
মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকট অর্থনীতির প্রধান সমস্যা

টাকার মান কৃত্রিমভাবে ধরে রাখার খেসারত দিতে হচ্ছে গোটা অর্থনীতিকে। ডলার-সংকটের প্রভাব এখন পুরো অর্থনীতিতে। এর ফলে লেনদেনে দেখা দিয়েছে রেকর্ড ঘাটতি, কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ঋণ পরিশোধে খরচ বেড়েছে, দেখা দিয়েছে জ্বালানির সংকট, অসহনীয় হয়ে উঠেছে মূল্যস্ফীতির চাপ। এটি ভুল অর্থনৈতিক নীতির খেসারত। এখন সরকারের অগ্রাধিকার হতে হবে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। তা না হলে সংকট আরো বাড়বে। বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন পথে এবং সমাধান কী—এ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।

ড. জাহিদ বলেন, অর্থনীতির বতর্মান অবস্থা বেশ নাজুক। কারণ অর্থনীতির চাকাটা যাতে ঘুরতে থাকে, সেজন্য যে সক্ষমতা দরকার, তার মধ্যে বড় গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ডলারের সংকট। এ কারণে প্রয়োজনীয় যে উপাদানগুলো অর্থনীতিকে সচল রাখে, সেগুলো আমরা জোগাড় করতে পারছি না। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হওয়ার পরে সংকট আরো প্রকট হয়েছে। এর ওপরে গ্যাসের সংকট আছে।

সরাসরি কারখানাগুলোকে গ্যাস দেওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া অর্থনীতিতে নানা ধরনের সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেওয়া সত্ত্বেও সেগুলো কোনো পরিপূর্ণতা পায়নি, যার কারণে বেসরকারি বিনিয়োগে উত্পাদনক্ষমতা বৃদ্ধিতে তেমন কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন নেই। তার ওপরে এখন যোগ হয়েছে ডলারের সংকট এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি। কর্মসংস্থানও হচ্ছে না। একদিকে যেমন আয়ের ক্ষেত্রগুলো সংকোচিত হচ্ছে, আরেক দিকে মানুষের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ, একই পরিমাণ পণ্য কেনার জন্য বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। এবং সেটা নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর জন্য বিরাট সংকট তৈরি করেছে।

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এসব তো আমাদের জাতীয় সমস্যা। প্রশ্ন হলো, সমাধানটা কে দেবে? শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে তো হবে না। সবাইকে সমাধানের একটা পথ খুঁজতে হবে। সেখানে আমাদের নীতিগত কৌশলগুলো কী হবে। সেখানে সরকারের ভূমিকাটাই সবচেয়ে বড়। নেতৃত্ব তো দেবে সরকার। সেই নেতৃত্বে আশা করি মৌলিক যে ম্যাক্রো পলিসিগুলো আছে, যেমন—বাজেট মুদ্রানীতি, কাঠামোগত বিভিন্ন পলিসি। এগুলোর মধ্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি পলিসি। এছাড়া ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারে যে নীতি আছে, সেখানে ব্যাপক সংস্কার দরকার। ম্যাক্রো পলিসির মধ্যে আমরা নতুন একটি বাজেট পেয়েছি। সেই বাজেটে মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় করার জন্য কিছু কিছু পদক্ষেপ আছে বটে। তবে বড় আকারের তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। বরং মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য উলটো পথে যাচ্ছে সরকার। যেমন—বড় বাজেট ঘাটতি, তারপর আছে বিভিন্ন ধরনের নতুন করারোপ।

ডলারের সংকট নিরসনে বাজেটে যেটা করণীয় ছিল তা হলো, ভবিষ্যতে সরকারের দিক থেকে যেন ডলার চাহিদার চাপটা না বাড়ে। আমি মনে করি, এখানে দুই দিক থেকে সমস্যাকে দেখতে হবে—এক. ডলারের চাহিদা কমানো; দুই. ডলারের জোগানটা বাড়ানো। আমরা এ পর্যন্ত ব্যক্তি খাতে চাহিদা কমানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছি। প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ। এটা দীর্ঘমেয়াদি করলে কিন্তু উৎপাদনের চাকা বন্ধ হয়ে যাবে। এমন তো নয় যে আমাদের আমদানির বেশির ভাগ হলো ভোগ্যপণ্য। দেশের আমদানি ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশই হচ্ছে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের ইন্টারমিডিয়েট গুডস। যেগুলো উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। অথচ এ সবই বেশি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি না এলে দেশে বিনিয়োগ হবে না। সরকার বাজেটে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে ২২ শতাংশ থেকে এক লাফে ২৭ শতাংশে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই বৃদ্ধিটা ডলার-সংকটের মধ্যে কীভাবে হবে? বাজেটে অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতায় দেখেছি, এত দিন ডলার-সংকটের রেসপন্সে যেসব নীতি অনুসরণ করা হয়েছে, ভবিষ্যতেও তা-ই থাকবে। এখানে ডলারের সংকট সমাধানে নতুন কিছু বলা হয়নি। হয়তো আগামী ১৮ তারিখ মুদ্রানীতিতে আমরা নতুন কিছু শুনতে পাব। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতা শুনে মনে হয়নি মুদ্রানীতিতে নতুন কিছু থাকবে। কারণ অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে সে ধরনের কোনো আভাস পাওয়া যায়নি।

আন্তর্জাতিক ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিস দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখন উঁচু মাত্রার দুর্বলতা ও তারল্যের ঝুঁকি রয়েছে। আমি বলব, এখানে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, মুডিস যে অবমাননা হলো, সেখানে যে কারণগুলো দেখিয়েছে, তার মধ্যে একটি বলেছে আনকনভেনশনাল পলিসিস। অর্থনীতির সমস্যা নিরসনের জন্য সাধারণত যে ধরনের পরাশর্ম আছে, সেগুলো অনুসরণ না করে আমরা ভিন্ন পথে হাঁটছি। তার মানে, বিভিন্ন সংকট নিরসনে তাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, যে পলিসিতে আমরা যাচ্ছি, তা কাজ করছে না। বরং সমস্যাটাকে আরো জটিল করা হচ্ছে। এটা তো আর মুডিসের বলে দেওয়া লাগে না।

আমরা গত দেড় বছর ধরে দেখছি, আর্থিক খাতে বলেন বা বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো যে পলিসিগুলো নিয়েছে, এগুলোর কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আসেনি। এটার জন্য তো আর বড় কোনো গবেষক হতে হয় না। বাজারে গেলেও বোঝা যাচ্ছে, আবার বাসায় থাকলেও বোঝা যাচ্ছে। তো এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে সেটাকে শোধরানোর মানসিকতা যদি আমাদের না থাকে, তাহলে তো হবে না। সরকার অতীতে যা করেছে, এখনো তা করতে চাইছে। তাহলে উত্তোরণ কীভাবে হবে? গত জুলাই থেকে আমরা শুনে আসছি, আগামী দুই মাসের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখনো সেই আগামী দুই মাস যায়নি (হা-হা-হা)। বারো মাস যাওয়ার পরেও আগামী দুই মাস যায়নি।

বাজেটে বরাদ্দের কাঠামো দেখে আমার মনে মনে হয় না এটি একটি সংকটের বছর। যথারীতি গতানুগতিক ধারাতেই আছি আমরা। বিদ্যুৎ খাতে বড় ধরনের বরাদ্দ আছে। অথচ নতুন নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্ল্যান্ট তৈরি করে সেগুলোকে বসিয়ে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই । ওখানেও তো আমরা ডলার ব্যয় করছি। আবার ওখান থেকে আমরা যখন বিদ্যুৎ কিনতে পারি না, তাদের আবার ক্যাপাসিটি চার্জ দিচ্ছি।গত কয়েক বছর ধরেই শুনে আসছি, আমরা এখন আর ঐ ‘নো পাওয়ার নো পে’ নীতিতে চলে যাব। ক্যাপাসিটি চার্জের নতুন চুক্তিতে এই বিধানগুলো রাখব না। কিন্তু বাজেটে অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতায়ও একই কথা বলেছেন, ভবিষ্যতে আমরা ‘নো পাওয়া নো পে’ নীতিতেই যাব। এর ফলে বাজেটের ওপর বোঝাটা বাড়ছে।

এই যে পায়রা বিদ্যুেকন্দ্র বন্ধ হলো, এটার মূল কারণ আমার মতে, ফাইন্যান্সিয়াল মিস মেনেজমেন্ট। কারণ এখানে বকেয়া যে বিলটা ছিল, সেটা আমরা পরিশোধ করিনি। মাসের পর মাস বকেয়া বিল জমে যাওয়ার কারণে কয়লা যারা সরবরাহ করত, তারা বলছে আমরা কয়লা সরবরাহ দেব না। বাজেটে বরাদ্দ তো ছিল। এখন বলা হচ্ছে, এই অর্থবছরের বরাদ্দে আগের অর্থবছরের বকেয়া পে করার জন্য বরাদ্দ ছাড়িয়ে গেছে আমাদের। আমরা পুরোপুরি এটিকে সংকুলান দিতে পারি নাই। বকেয়া হয়ে যাওয়াটাই অব্যস্থাপনার একটি লক্ষণ।

আমাদের রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। তার পরও বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিদিনই ডলার বিক্রি করছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই ডলারগুলো যাচ্ছে কোথায়? অর্থনীতি সচল রাখার জন্য আমাদের অগ্রাধিকারগুলো কী, তা ঠিক করা জরুরি। অল্পস্বল্প যে রিজার্ভ আছে, তা দিয়ে কারা কী কিনছেন তা দেখতে হবে। ঐখানে আমি অনেক অব্যবস্থাপনার লক্ষণ দেখতে পাই। যেমন—বিদ্যুতের বকেয়া জমে যাওয় এটি একটি। বিদ্যুেকন্দ্র আছে, কিন্তু উত্পাদনক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছি না। কিন্তু নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রর চুক্তি করছি আমরা। এসবের পেছনের কারণ রাজনীতি ও অর্থনীতির ব্যাপার। মোটাদাগে আমি বলছি, সাদা চোখে যা দেখছি, সেটা হচ্ছে অব্যবস্থাপনা। আমি গ্যাস দিতে পারছি না, কিন্তু নতুন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে যাচ্ছি।

প্রস্তাবিত বাজেট আমরা ইচ্ছা করলে এখনো পরিবর্তন করতে পারি। সরকারি যেসব প্রকল্প ডলারের ওপর চাপ বাড়াবে, সেগুলো আপাতত বন্ধ করতে হবে। যে ডলার সরকার কিনে নিচ্ছে, সেই ডলার তো ব্যক্তি খাতে যাচ্ছে না। আশা করছি আগামী মুদ্রানীতিতে ডলারের জোগান বাড়ানোর ব্যবস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক নেবে। বাফেদা ডলারের দাম নির্ধারণ করছে, কিন্তু সেটা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশেই করছে। এই যে হুকুম দিয়ে মুদ্রার বিনিয়মমূল্য বেধে দেওয়ায় ডলারের জোগান কমেছে। রেমিট্যান্সের দিক থেকেও কমেছে। রপ্তানিতেও কমেছে। রপ্তানি আমরা জাহাজে ওঠাচ্ছি প্রচুর, কিন্তু সেই পরিমাণ ডলার দেশে আসছে না। হুকুম দিয়ে ডলারের দাম বাড়ালে সমস্যার সমাধান হয় না। ডলারের দাম বাজারভিত্তিক নয়। এটি আমলাদের সিদ্ধান্ত। ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ